মিন্নি, এসপি এবং মিডিয়া ট্রায়াল

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ আমীন আল রশীদ , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বরগুনায় রিফাত হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নির জামিন বিষয়ক রায়ে হাইকোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন, যা বছরের পর বছর ধরে সচেতন নাগরিকদের মনে ছিল। বস্তুত এই নির্দেশনার মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালত এমন একটি বিষয়ের অবতারণা করলেন, যা প্রকারান্তরে মানবাধিকারের সঙ্গেও সম্পর্কিত। যে নির্দেশনাটি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিই নয়, বরং এই নির্দেশনায় পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন উচ্চ আদালত।

হাইকোর্ট বলেছেন, মামলায় তদন্তের অগ্রগতি বা কাউকে গ্রেপ্তার ও আটকের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের যে ব্রিফ করে, তার একটি নীতিমালা থাকা দরকার। প্রসঙ্গটি এসেছে মিন্নির কারণেই। কেননা তিনি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বরগুনার জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন বলে বরগুনার এসপি যে বক্তব্য দেন, আদালতে তাকে শুধু অযাচিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, বরং ন্যায়-নীতি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী বলেও মন্তব্য করেন। হাইকোর্ট বলেন, পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যাই হোক না কেন, পুলিশ সুপারের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্য জনমনে নানা প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে।
আদালত যেকোনও ঘটনার তদন্তের সময়ে কিংবা অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও আটকের পরে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে এমনকি অনেক সময় বুকের উপর ‘আমি জঙ্গি, আমি ইয়াবা কারবারি, আমি ধর্ষক’ ইত্যাদি লিখে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে এবং গণমাধ্যমও সেই ছবি অনায়াসে প্রকাশ ও প্রচার করে। দীর্ঘদিন ধরে এর সমালোচনা হলেও এটি বন্ধ হয়নি।

আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে এভাবে জঙ্গি, ধর্ষক, ইয়াবা কারবারি, খুনি ইত্যাদি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে জাজমেন্ট বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় এবং সেটি গণমাধ্যমে প্রচারের মধ্য দিয়ে যে একধরনের মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায়, সেটি মানবাধিকারেরও পরিপন্থী। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে এভাবে জঙ্গি ধর্ষক, খুনি বা মাদক ব্যবসায়ী বলে রায় দিয়ে দেয়ার পরে যদি আদালতে প্রমাণিত হয় যে তিনি অপরাধী নন, তখন এর ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে?

মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তাকে সমাজের কাছে যেভাবে হেয় করা হলো, তার পরিবারকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হলো, তার ক্ষতিপূরণ কি রাষ্ট্র দেয়? বরং কাউকে অপরাধী হিসেবে একবার মিডিয়ার সামনে হাজির করার পরে যদি শেষমেষ তিনি নিরপরাধ প্রমাণিতও হন, তারপরও তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন। তাকে এবং তার পরিবারকে সারা জীবন একটা ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো বলবে যে, তারা তথ্যপ্রমাণসহই প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার বা আটক করে। খুব সামান্য সংখ্যায় হয়তো নিরপরাধ লোক ধরা পড়ে এবং শেষমেষ প্রমাণিত হয় যে তারা নিরপরাধ। যদি তাও হয়, তারপরও কাউকে মিডিয়া ট্রায়ালে বিচারের সুযোগ নেই। কারণ একশো অপরাধীর মধ্যে যদি একজন নিরপরাধ লোকও এভাবে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হন, সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনী নিজেরাই যদি কাউকে অপরাধী বলে রায় দিয়ে দেয় এমনকি শীর্ষ সন্ত্রাসী, ইয়াবা কারবারি অথবা ধর্ষণকারী অভিযোগে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে, তাহলে আর প্রচলিত বিচারব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের পরে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা আর ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য নেই।

এ কারণে আদালত মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না সে অপরাধি বা অপরাধ করেছে। তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত নয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী।’

২.

এখন প্রশ্নটা একটু নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে বলা দরকার, আইনশৃঙ্খলা বা গোয়েন্দা বাহিনী কাউকে আটকের পরে নিজেদের বীরত্ব বা কাজ দেখানোর জন্য না হয় তাদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করলোই, কিন্তু গণমাধ্যম সেটি প্রকাশ ও প্রচার করে কেন? কেন পুলিশ যা বলে সাংবাদিকরা হুবহু সেটা ছেপে দেন বা টেলিভিশনে প্রচার করেন? এখান গণমাধ্যম তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না বা এরকম ঘটনায় সাংবাদিকরা কখনও এসব ব্রিফিংকে চ্যালেঞ্জ করেছেন কি না?

ধরা যাক পুলিশ কারো বুকের উপর সন্ত্রাসী, ধর্ষক, মাদক ব্যবসায়ী ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করলো, কিন্তু কয়টি ঘটনায় সাংবাদিকরা পুলিশের এই ব্রিফিংয়ের পরে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে সঠিক রিপোর্ট উপস্থাপন করেছেন? বড়জোর যেটি দেখা যায়, পুলিশ কোনো অভিযোগ করার পরে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাংবাদিকরা ফোন করেন এবং স্বভাবতই তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। সাংবাদিক তখন লিখে দেন, ‘এ বিষয়ে অমুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন’।

সাংবাদিকতা এখন একধরনের কেরানির চাকরিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্রিফিংয়ের সংবাদ দেখলে অনেক সময়ই মনে হয় তারা বুঝি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা। সাংবাদিক হিসেবে এই দায় আমি নিজেও এড়াতে পারি না। সুতরাং এখন ব্রিফিংয়ের বিষয়ে আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নীতিমালা করার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তখন গণমাধ্যমেরও নীতিমালা ঠিক করা উচিত যে, তারা এসব ব্রিফিং কতটুকু এবং কীভাবে প্রকাশ ও প্রচার করবে?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলবে হুবহু সেটিই প্রকাশ ও প্রচার করবে নাকি সেই অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই করবে? এখানে পাল্টা প্রশ্ন আসতে পারে যে, সাংবাদিকদের এত সময় কোথায়? বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবাদিকদের? ফলে এখানেও ওই নীতিমালার প্রশ্ন। টেলিভিশন সাংবাদিকতাকে অনেক দিন ধরেই আমরা ‘বলেছেন জার্নালিজমে’ পরিণত করেছি। অর্থাৎ ‘তিনি বলেছেন, তিনি আরও বলেছেন, তিনি মনে করেন’—এর বাইরে কিছু নেই। সুতরাং এই জায়গা থেকেও বের হওয়ার সময় এসেছে।

৩.

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্রিফিংয়ে আরেকটা বিষয় নিয়েও এখন প্রশ্ন তোলা দরকার, তা হলো কথিত গোপন বৈঠক এবং জিহাদী বই। কোনো অভিযান বিশেষ করে বন্দুকযুদ্ধে কারো নিহত হওয়ার পর র‌্যাব,পুলিশ বা ডিবি যে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠায় সেখানে একটি কমন বাক্য থাকে যে, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে’ সেখানে অভিযান চালানো হয়। সাংবাদিকরাও হুবহু সেটি লিখে দেন যে, পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। প্রশ্ন হলো, গোপন সংবাদের ভিত্তিটা কী? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানেই অভিযান যাক না কেন, কোনো না কোনো তথ্য বা সংবাদের ভিত্তিতেই যায় বলে ধরে নেয়া হয়।

অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকটি অভিযানেরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। তারা একজন আসামিকে ধরতে যাওয়ার আগেও তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। বিভিন্ন স্থানে তাদের লোক থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে চৌকিদারসহ নানা সোর্স থাকে। তারাই পুলিশকে খবর দেয়। এখানে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। সুতরাং পুলিশের যেকোনো অভিযানই ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে’ হয়, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আলাদা করে সংবাদে এই শব্দ উল্লেখ করা হলে প্রেসবিজ্ঞপ্তি এবং সংবাদের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ভাষায় সংবাদ সম্মেলনে কথা বলে বা প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠায়, গণমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করার নামই সাংবাদিকতা।

এরপর আসে জিহাদি বইয়ের প্রসঙ্গ। কোনো নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন বা জামাত শিবিরের লোকজনকে ধরার পরে পুলিশ ব্রিফিংয়ে বা প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলে যে, আটককেৃতদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো জিহাদি বইয়ের সংজ্ঞা কী? কখনো সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা এই প্রশ্ন করেছেন? র‌্যাব, পুলিশ বা ডিবির কাছে জিহাদি বইয়ের কোনো তালিকা বা সংজ্ঞা আছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ যাবত যতগুলো কথিত জিহাদী বই উদ্ধার করেছে, সেগুলোর কি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তাদের কাছে আছে?

অর্থাৎ উদ্ধারকৃত বইগুলোর ধরন কী, সেগুলোর লেখক কারা, বইয়ের ভেতরে কী আছে, প্রকাশক কারা, কোথা থেকে ছাপা হয় ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর কি গণমাধ্যম কোনোদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছে? নাকি তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংবাদ সম্মেলনে যা বলে সেটিই প্রকাশ ও প্রচার করে? এক্ষেত্রে গণমাধ্যম কেন অধিকতর অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় না? ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে উচ্চ আদালত যে নীতিমালা করার নির্দেশনা দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি জরুরি সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ গণমাধ্যম কীভাবে কাভার করবে এবং কতুটুক প্রচার ও প্রকাশ করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়া এবং এ বিষয়ে একটা নীতিমালা করা এখন সময়ের দাবি। যদিও বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবেন, সেটিও একটি বড় তর্কের বিষয়ে পরিণত হবে।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এইচআর/জেআইএম

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে উচ্চ আদালত যে নীতিমালা করার নির্দেশনা দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি জরুরি সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ গণমাধ্যম কীভাবে কাভার করবে এবং কতুটুক প্রচার ও প্রকাশ করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়া এবং এ বিষয়ে একটা নীতিমালা করা এখন সময়ের দাবি। যদিও বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবেন, সেটিও একটি বড় তর্কের বিষয়ে পরিণত হবে।

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।