ভ্রান্তিবিলাস নাকি পুরোনো পতাকা উঁচিয়ে জয়োল্লাসের চিন্তা!
এক টেস্টে চার স্পিনার নিয়ে খেলতে নামল বাংলাদেশ। তাও আফগানিস্তানের বিপক্ষে! টেস্ট ক্রিকেটে যাদের পদচারণা এক বছরের দুই মাস হয়নি এখনও। সেই দলটার বিপক্ষে একাদশে কোনো পেস বোলার রাখার সাহস দেখাতে পারল না বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। ব্যাখ্যা হয়তো বহুমুখী। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে; ক্রিকেটীয় চিন্তাকে প্রাধান্য না দিয়ে পুরোনো সাফল্যের কিছু সহজ অংক মেলানোর চেষ্টা।
স্পিন দিয়ে নিজের মাটিতে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দেয়া গেছে তিনদিনে। আফগানিস্তান আর এমন কী দল। হয়তো এই চিন্তাই প্রাধান্য পেয়েছিল টিম কম্বিনেশন দাঁড় করাতে। কিন্তু চট্টগ্রামের উইকেট কি আর তিন দিনের? যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। প্রথমদিন থেকে বল লাড্ডুর মতো ঘুরবে। হাঁটুর নিজে বল থাকবে। আর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে আফগান ব্যাটিংলাইন! স্বপ্ন জড়ানো চোখ আর বাস্তবচিন্তাহীন মস্তিষ্ক নিয়ে বিষয়গুলো ভালোই লাগে। কিন্তু যুদ্ধ, বোমা, আর বারুদের গন্ধের মধ্যে যাদের বেড়ে ওঠা, তাদের কাছে বাস্তবতা অন্য জিনিস। যুদ্ধজয়ের মানসিকতা নিয়ে আফগানরা চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে তার প্রমাণ রাখতে শুরু করে প্রথমদিন থেকেই।
প্রায় দুই যুগ ধরে যারা টেস্ট খেলছে, একশর বেশি টেস্ট খেলে ফেলার পরও বাংলাদেশ এখনও যেন টেস্ট ক্রিকেট কী সেটা বোঝার চেষ্টা করল না! ওয়ানডে ভূত এখনও এদেশের মানুষের কাঁধে। একটা-দুটো ম্যাচ যদি বড় দলের বিপক্ষে জিতে যায়, তখনই তারা স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জেতার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সব ফরম্যাটের ক্রিকেটের মাতৃগর্বতো সেই টেস্ট ক্রিকেট। সেই খেলাটার প্রতি একটু বেশি বিমাতাসুলভ আচরণ, ক্রিকেট পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের। সেটা দেশজ ক্রিকেটের অবকাঠামো আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের চেহারায় অপুষ্টির ছাপ দেখলেই বোঝা যায়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের চেহারা ফেরানোর কতটা উদ্যোগ নিয়েছেন বিসিবি কর্তারা? তারচেয়ে তাদের বেশি মনোযোগ বিপিএল নামক ক্রিকেটের একেবারে ক্ষুদ্র সংস্করণে। কারণ যতটা ক্রিকেটীয় তারচেয়ে বেশি নিজেদের স্বার্থ এবং এই জায়গায় স্বার্থ-দ্বন্দ্ব শব্দযুগলের কথা ভুলে যান তারা। বিপিএল বিসিবির সম্পত্তি দাবি করে সাকিবদের পরোক্ষভাবে হুমকি-ধামকি দিতেও কার্পণ্য করেন না। কিন্তু ক্রিকেট বাংলাদেশের সম্পত্তি, এটা শুধু বিসিবির জনাকয়েক প্রতিনিধির নয়, এই উপলব্ধি না আসলে টেস্ট প্লেয়িং নেশন হিসেবে নিজেদের পতাকাটা সেভাবে তুলে ধরতে পারবে না বাংলাদেশ।
অন্যের ফেলে দেয়া পতাকা তুলে ধরার চেষ্টা কী লাভ সেটা সময় বলে দেবে। তবে আপাত ইতিহাসের পাতা খুঁজে এক তথ্য তুলে ধরতেই হচ্ছে। ভারত এক সময় স্পিননির্ভর দল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যার ফল শুধু দেশের মাটিতে ছাড়া বিদেশের মাটিতে টেস্ট জেতার নজির খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্তর দশকে এসে একটু একটু বদলাতে থাকে তাদের সেই চিন্তা। একজন কপিল দেব সেই ভারতীয়দের সেই চিন্তায় আঘাত হানে। যার অভিঘাত আজ ভারত একাধিক ফাস্ট বোলারকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখার বিলাসিতা দেখাতে পারে। কাকে রেখে কাকে খেলাবে সেই মধুর সমস্যায় এখনকার ভারত অধিনায়ক।
কিন্তু তার আগে ১৯৬৭-তে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এজবাস্টন টেস্টে বিখ্যাত চার স্পিনারকে এক সঙ্গে নিয়ে খেলতে নেমেছিল। কিন্তু বেদী, চন্দ্র শেখর, ভেঙ্কট, প্রসন্ন এই চারজন মিলে অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদির মুখের প্রসন্নতা বাড়াতে পারেননি বরং উল্টো হয়েছিল। ম্যাচ হেরেছিল ভারত বড় ব্যবধানে। ভারতের ফেলে আসা সেই পুরোনো ফরমুলা অনুসরণ কেন করছে বাংলাদেশ, সেটা শুধু বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট জানেন। তবে আপাতত একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেছে, চট্টগ্রাম টেস্ট দেখতে বাংলাদেশের আগামী দিনের কোনো ক্রিকেটার, আর যাই হোক পেস বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন না। কারণ, তাদের কাছে একটা বার্তাই যাচ্ছে এই টেস্ট থেকে ড্রেসিংরুম থেকে টিম ম্যানেজমেন্টের বার্তা আর পানি বয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ দলের পেসারদের দেশের মাটিতে কোনো কাজ নেই!
এইচআর/বিএ/এমএস