রুমিন প্লট চান, আরাফাত ফিরিয়ে দেন!
‘প্রকৃত’ এবং ‘আপাত’ বলে পদার্থে দুটো শব্দ রয়েছে। আপাত এমনই এক বিভ্রম যে কখনও কখনও আপাতকে ‘প্রকৃত’ বলে মনে হয়। কিন্তু শেষাবধি আপাত আপাতই, প্রকৃত নয়। আর প্রকৃত প্রকৃতই। তাকে কিছু মনে হতে হয় না, হওয়াতেও না। সে তার মতো প্রকৃত। নিখাদ, খাঁটি, সত্য।
পদার্থবিদ্যার অনেক কিছু সামাজিক বিশ্লেষণে আমাকে ভীষণ কাজে দেয়। এমনকি ব্যক্তি মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণেও ফ্রয়েড, রোষাক বা লাঁকান এর পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা এসে দাঁড়ায়। আর দাড়াঁবেইতো, ব্যক্তি তো পদার্থেই তৈরি। তার বোধ, বিবেচনা, নৈতিকতা, বিশ্বাস, আদর্শ, চিন্তা সেও তো আরেক পদার্থই।
রুমিন ফারহানা। জনপ্রিয় মুখ টেলিভিশনের। তথ্য সত্যাসত্য যাই হোক, গুছিয়ে বলতে পারেন। স্মার্ট, প্রেজেন্টেশন ভালো। মনে হয় সাহসী একজন নারী, প্রতিবাদী, সত্যের মশাল হাতে মিছিলে নেমেছেন। কিন্তু এই মনে হওয়া সাহস, প্রতিবাদ, সত্য আসলে প্রকৃত নয়, আপাত। মনে হওয়া, বানানো। কৃত্রিম। সিনথেটিক। লোক দেখানো। কেননা, সাহস, প্রতিবাদ, সত্যের নেপথ্যে যে পদার্থটি থাকে, জ্বলতে থাকে আগুনের মতো তা সততা। যা একজন রুমিনের নেই। ফলে আপাতভাবে অনেক কিছু মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার তা নেই। ‘আপাত’ আর ‘প্রকৃতের’ পার্থক্য এখানেই।
রাজনীতির মানুষদের অনেকেই অপছন্দ করেন। ফেসবুকে ঢুকলেই আমার চেয়েও তরুণ যারা তাদের অনেকেরই কমন স্ট্যাটাস‘আই হেইট পলিটিক্স’। মানুষ যখন কাউকে বিশ্বাস করতে না পারে, অবিশ্বাস করে, তখনই বিশ্বাস ভঙ্গের মানুষগুলোকে অপছন্দ করে। অপছন্দের মাত্রা যখন চরমে পৌঁছায় তখন ঘৃণা করে। রাজনীতির দোষ নেই, দোষ মানুষের। মানুষ যখন মিথ্যা বলে, মুখোশ পরে, দিনে এক রাতে আরেক, সামনে এক পেছনে অন্য, কথা দিয়ে কথা রাখে না তখন ঘৃণা তো মানুষ করবেই। মানুষতো শেষাবধি সততা চায়, মানবিকতা চায়, মূল্যবোধের মূল্যায়ন চায়। তা অনুপস্থিত থাকলে সে মানুষ যতই চকচকে হোক চলবে কেন?
আমি ভেবেছিলাম, নির্বাচন বৈধ নয়, সরকার বৈধ নয়, সংসদ অবৈধ বলে চিৎকার করতে থাকা রুমিন হয়তো সংসদে গিয়েছেন, ‘প্রতিবাদ’ হিসেবে। তিনি একটা উদাহরণ হতে চান প্রতিবাদের। কিন্তু সাংসদ হিসেবে নিয়মিত বেতন-ভাতা, করবিহীন গাড়ি এমন অনেক সুবিধের পরও তথ্য গোপন করে রুমিনের ১০ কাঠা প্লট চাওয়া সত্যিই বিস্মিত করেছে অনেককেই।
আসলে রুমিন যা তা-ই করেছেন তিনি। তিনি তার স্বভাব থেকে বেরুতে পারেননি। নৈতিক ভিত্তি না থাকলে এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সমাজে এমন হিপোক্রেট, ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের লোকই হয়তো বেশি। আর এ কারণেই তো সমাজে এতো অনাচার, অযাচার, মুখোশের উপর মুখোশ। বাইরে চকচকে, মসৃণ, ভেতরে কদর্য, অশ্লীল। যারা সামান্য সুযোগও হাতছাড়া করতে চান না, পারেন না। লোভ আর লাভ ছাড়া বোঝে না কিছুই।
তবে এমন ঘটনার বিপরীত মানুষও আছেন। আছেন একেবারেই অন্য মেরুর মানুষ। যারা বাস করেন একেবারেই নির্লোভ, নির্মোহ এক জগতে। এই জগৎ অন্য কোন জগৎ নয়, দূরের নয়। জগতটি তৈরি করতে হয় নিজের মধ্যে নিজেকেই। এই মানুষেরাও আমাদের চারপাশে থাকে, প্রকৃত মানুষ। কিন্তু আমরা হয়তো তাদের ভেতরটা জানি না, আবিস্কার করি না। করবার সুযোগও হয়তো তারা আমাদের দেয় না।
এমন অনাবিষ্কৃত মানুষদেরই একজন মোহাম্মদ এ আরাফাত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক, সংগঠকও একই সঙ্গে। প্রত্যক্ষ রাজনীতির মানুষ। টেলিভিশনে তিনিও একই সঙ্গে জনপ্রিয়-অজনপ্রিয়। একটি অংশ তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। অন্য অংশটি তীব্র অপছন্দ করে, রীতিমত ঘৃণা করে। এই অংশটি বাংলাদেশ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, পাকিস্তানপন্থি। এই অংশটি বঙ্গবন্ধুরও বিরোধিতা করে। এরা মূলত রাজাকার, জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, বিএনপি’র সমর্থক। এটি বাংলাদেশের অন্ধকার অংশ।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লড়াই সংগ্রাম করবার কারণে মোহাম্মদ এ আরাফাতের অনেক কাজ, কথা, লেখা আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষেই যায়। নৈতিকতা, যৌক্তিকতার বিবেচনায় তিনি সরকারের অনেক কিছুকেই প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। এই সমর্থন কখনও কখনও জয় বাংলার আদর্শে অনুপ্রাণিত মানুষদের সাহস ও শক্তি যোগায়। তরুণদের উজ্জীবিত করে নবপ্রাণে। তার মধ্যে কোন রাখ-ঢাক নেই। ভান-ভণিতা নেই। মুখ ও মুখোশ নেই। সামনে এক পেছনে আরেক নেই। যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন, করেন। বিশ্বাসের বাইরে কিছু বলেন না, করেনও না।
কিছুদিন আগে সরকার দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের নির্ধারিত বরাদ্দ থেকে প্লট দেয়ার একটি উদ্যোগ নেয়। সকল সরকারের সময়ই এটি একটি নিয়মিত উদ্যোগ। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, গুণীজনেরা এই প্রক্রিয়ায় প্লট পেয়ে থাকেন। অতীতেও পেয়েছেন। ভবিষ্যতেও পাবেন । এটিই সরকারি নিয়ম। মোহাম্মদ এ আরাফাতও নির্বাচিত হয়েছেন সরকারি প্লটের জন্য। সরকারি লোকজন এসেছে তার কাছে প্লট প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। কিন্তু তিনি সবাইকে হতাশ ও বিস্মিত করে দিয়ে সেই ‘সরকারি প্লট’ফিরিয়ে দিয়েছেন। নিতে চাননি, নেনওনি।
মানুষের প্রত্যাখ্যান করার শক্তি সম্ভবত সবচেয়ে বড়। অন্যরা যেখানে পাবার জন্য মরিয়া, প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, আরাফাত সেখানে তা নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিতে পারেন। আরাফাতের ব্যাখ্যাটি হলো, তার ঢাকায় নিজের কোন ফ্ল্যাট, প্লট নেই সত্য। ভাড়া বাসায় থাকেন। কিন্তু দেশ বিদেশের পড়াশোনা, দীর্ঘদিনের চাকরি, কাজের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতায় তিনি হয়তো নিজেই একটি ফ্ল্যাট বা প্লট কিনতে পারবেন। আর বিশিষ্টও নিজেকে মনে করেন না তিনি। পাশাপাশি তার অনেক কাজ যেহেতু সরকারকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয় তখন প্লট নিলে মনে হবে, মনে হতেই পারে হয়তো কিছু পাবার জন্য এই সমর্থন ছিল। কিছু মানুষ থাকে পাবার চেয়ে দেবার কথা ভাবে। অন্যের কাছে যা শূন্যতা তার কাছে তা পূর্ণতা।
এই মানুষদের অপ্রাপ্তি থাকে না, থাকে না পাবার উদগ্র আকাঙ্খা। তারা তাদের বিশ্বাস আদর্শের আলোয় এগিয়ে যান। এই যাত্রা-ই তাদের প্রাপ্তি। আর যাত্রাপথে যে আলোক বিচ্ছুরণ ঘটে, তাতে আলোকিত হয় দেশ, মানুষ, সমাজ। মোহাম্মদ এ আরাফাত সেই ‘প্রকৃত’মানুষদেরই একজন। কারো ব্যক্তিগত জীবন বা জীবনের কিছু অনুমতিহীনভাবে ‘পাবলিক’ করা অনুচিত, অন্যায়। আমার নিজেরও তা স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু যেখানে ‘আপাত’ সততার ছদ্মবেশধারী রুমিনরা তথ্য গোপন করে প্লট চান, সেখানে একজন ‘প্রকৃত’ দেশপ্রেমী মোহাম্মদ এ আরাফাত সরকারি প্লট বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই পরিচয়টিও প্রচার করেন না কোন সুবিধা পাবার আশায়। তখন সততার প্রশ্নে, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে, ইতিবাচক রাজনীতির প্রশ্নে চেয়েছি মানুষকে তা জানাতে।
মোহাম্মদ এ আরাফাত মাফ করবেন, ক্ষমা করবেন আমাকে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর