সীমাবদ্ধ জীবনের অসীম ভালোবাসা

ডা. বিএম আতিকুজ্জামান
ডা. বিএম আতিকুজ্জামান ডা. বিএম আতিকুজ্জামান
প্রকাশিত: ০৮:৩২ পিএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আজ সবার তাড়াহুড়ো।

হ্যারিকেন ‘ড্যারিয়েন’ ধেয়ে আসছে অরলান্ডোর দিকে। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া সবার।

এরই মাঝে কিছু রোগীরও তাড়া আছে তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাবার।

আজ জোসেফ তার বাবা-মার সাথে এসেছে। এ পুরো পরিবারটি আমার খুব কাছের। গত পনেরো বছর ধরে আমি ওদের চিনি।

জোসেফের বয়স এখন বত্রিশ। জোসেফ জন্মেছিল শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে। ও দেখতে পারে, শুনতে পারে। কথা বলতে পারে না, তার হুইল চেয়ার ছেড়ে বাইরে বেরোতে পারে না। ওর মা জেসেনিয়া পরম আদরে বেড়ে তুলেছে তাকে। জোসেফ তার প্রথম সন্তান। জোসেফ জন্মাবার পর থেকে জেসেনিয়ার জীবন বদলে যায়।

তেইশ বছর বয়সে তার কোলজুড়ে আসে জোসেফ। তখন সে ইউনিভার্সিটি শেষ করে কেবল একটি ব্যাংকে কাজ শুরু করেছে। তার সারা জীবনের শখ বড় একজন ব্যাংকার হওয়ার। একজন ল্যাটিন আমেরিকার অধিবাসী হিসেবে তার ভবিষ্যতে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার অভিলাষ আমাদের মতোই। সে স্বপ্নে বাধ সাধলো জোসেফ। একজন পুরোপুরি প্রতিবন্ধী সন্তানকে বড় করতে গিয়ে তার সারা জীবনের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিলো সে।

জোসেফ জন্মাবার তিন বছর পরই তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেলো। তার পরিবার-পরিজন এগিয়ে এলো তার সাহায্যে। কিছু সময় কাজ, কিছু সময় পড়াশোনা আর অধিকাংশ সময়ই তার কাটে জোসেফের সেবা করার জন্য। এদেশে এ ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবা করার জন্য আবাসিক প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু জেসেনিয়া কোনো দিন জোসেফকে সেখানে দেয়ার চিন্তা করেনি। জোসেফ তার দিকে তাকিয়ে হাসে, মাথা নাড়ে। জোসেফিন সব বোঝে। জোসেফের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা- উচ্ছ্বাসের ভাষা আর কেউ বোঝে না জেসেনিয়ার মতো।

বিশাল সংগ্রামের মাঝে জেসেনিয়া আস্তে ধীরে পড়াশোনা করে একজন পাবলিক একাউন্ট্যান্ট হয়েছে বছর দশেক আগে। নিজেই একটি ছোট একাউন্টিং ফার্ম খুলেছে। এখন তার আধা ডজন কর্মচারী।

জেসেনিয়ার রাউলের সাথে পরিচয় হয় প্রায় বিশ বছর আগে। সেও একজন একাউন্ট্যান্ট। দুজন দুজনের পাশে থাকে সব সময়।

jibon

জোসেফের যত্ন করার জন্য আর কোনো সন্তান নেয়নি জেসেনিয়া আর রাউল। ওরা দেশ-বিদেশে ঘুরতে যেতে পারে না। চাইলেই পছন্দের রেস্তোরাঁয় জোসেফকে নিয়ে যেতে পারে না। শপিংমলে কিংবা ছবি দেখতে যাওয়ার আগে চিন্তা করতে হয় তাদের।

বিশ্বভ্রমণের ভীষণ শখ ছিল তাদের। সব সময় আমার ভ্রমণের গল্প শুনতে চায় তারা। জেসেনিয়া আর রাউলের চোখ জ্বলজ্বল করে। আমি একটা দুঃখ অনুভব করি।

ওদের প্রিয় ঘুরবার জায়গা ডিজনি ওয়ার্ল্ড। তারা জোসেফের মতো প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর জন্য চমৎকার ব্যবস্থা করে রাখে। তাদের পরিবারের জন্য আলাদা ভাবে বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।

জেসেনিয়ার খুব ইচ্ছা ছিল তার জন্মভূমি পেরুতে যাবে, জোসেফকে নিয়ে মাচুপিচু যাবে। কিন্তু সে জানে এ জীবনে সেটি হবে না। জেসেনিয়া সীমাবদ্ধ জীবনে অসীমের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়।

এবারো যাওয়ার আগে জেসেনিয়া জোসেফকে বললো, ডাক্তারকে বিদায় বলো। জোসেফ তার চিরচেনা মিষ্টি হাসিটি দিলো। আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো।

হ্যারিকেনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তারা। সব কিছুই জোসেফকে ঘিরে। ওর দুই সপ্তাহর খাবার-দাবার, ডাইপার, ওষুধপত্র, ওর রুমের আলো-বাতাসের জন্য জেনারেটর সব প্রস্তুত।

প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য মাদের ভালোবাসা একটি সুস্থ সন্তানের চেয়েও গভীর। মা জানে তারা কতো অসহায়।

এসব মাদের সীমাবদ্ধ জীবনে থাকে অসীম ভালোবাসা।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।