‘মুজিববর্ষ’ এবং শেখ মুজিব
‘মুজিব বর্ষ’-র দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতি। চারিদিকে শুরু হয়েছে ‘মুজিব বর্ষ’ নিয়ে একটা উৎসবের বাতাবরণ। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, ইতিহাস, বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী অন্যভাবে পালিত হবে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, বঙ্গবন্ধু মানেই তো বাংলাদেশ।
বত্রিশ নম্বর বাংলাদেশের ঠিকানা। কিন্তু শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর ঠিকানা টুঙ্গিপাড়ার সেই গ্রামে। সেখানেও নগরায়ণের ছোঁয়া লেগেছে। অনেক কিছুরই পরির্বতন হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি কোথায় থাকতেন? কেমনভাবে পালিত হতো তাঁর জন্মদিন? বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট এক আত্মীয়কে প্রশ্নটা করেছিলাম বেশ কিছু দিন আগে। বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায়, ধানমন্ডি বত্রিশে খুব কাছ থেকে দেখা ভদ্রলোক একটু সময় নিলেন। তিনি বললেন; ‘বেঁচে থাকলে কী বলতেন, সেটা আমি কেন, বাকি কারো জানা আছে বলে আমার মনে হয় না!
আসলে বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন। যা করেছেন। সেটা খুব ভেবে চিন্তে বলেছেন। করেছেন। সাধারণের বঙ্গবন্ধু কথাগুলো বলতেন সাধারণের মত করে। কিন্তু ভাবতেন অনেক গভীরে। যদিও বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন ; বঙ্গবন্ধু খুব আবেগপ্রবণ ছিলেন। হ্যাঁ, তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন দেশ, আর মানুষের প্রতি। আমার দেখা সাতাশ-আঠাশ বছরে মনে হয়েছে, তিনি নিজেকে নিয়ে মোটেও ভাবতেন না। আর নিজের জন্মদিন? হয়তো বেঁচে থাকলে শতবর্ষেও দরাজ গলায় বলতেন; ‘আামার আবার জন্মদিন কীসের? আমি কী সাহেব নাকি বার্থডে সেলিব্রেট করবো?’
তিনি সাহেব নন। তিনি ব্রিটিশ নন। তিনি মার্কিনী নন। তিনি নিখাঁদ বাঙালি। তাই বাঙালি তাঁর জন্মদিন পালন করবে। শততম জন্মদিন। সেই সেঞ্চুরিটা উদযাপন হবে না তাই বা কী করে হয়! তবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি যিনি, তিনি কী শুধুই বাংলাদেশের? শুধুই বাঙালির? বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে পড়েছে তাঁর উজ্জ্বল আলো। বিশ্বও আজ তাই নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। তিনি কী শুধু কী বঙ্গবন্ধু নাকি বিশ্ববন্ধু? তাঁর জন্মদিন তা হলে কী শুধু বাংলায় না বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হবে? উত্তরটা জমা থাকলো সময়ের কাছে।
তবে লম্বা একটা সময় বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে ক্রিকেট কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি;‘ আমরা এখন নার্ভাস নাইনটিজে। আর মাত্র একটা সিঙ্গেল হলেই সেঞ্চুরি হবে বঙ্গবন্ধুর। সেটা উদযাপনের সময় আমরা শুধু জানবো না, বাংলাদেশের স্থপতি পঞ্চাশের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চেয়েছিলেন। আর আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?
ক্রিকেট রোমান্টিকের মত শুধু সংখ্যা দিয়ে সেঞ্চুরিটাকে মূল্যায়ন করতে গেলে ভুল হবে। মারাত্মক ভুল। বঙ্গবন্ধুর জীবনের হাফ সেঞ্চুরিই সেঞ্চুরির চেয়ে অনেক অনেক মূল্যবান। সেঞ্চুরি শব্দটা বার বার ঢুকে পড়ছে লেখাটার মধ্যে। সেটা ইচ্ছা-অনিচ্ছার মিশেলে। দিল্লির এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু এক সময় যিনি প্রচুর ক্রিকেট কাভার করেছেন, এখন ক্রিকেট বক্স ছেড়ে দ্য হিন্দুর ডেপুটি এডিটর। ভদ্রলোক দিল্লির খান মার্কেটে কফি খেতে বলেছিলেন; ‘তোমাদের দেশের ক্রিকেট আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে। আমিতো বহুবার গিয়েছি।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনও ফলো করি। কিন্তু মাঠে-ঘাটে আর যাওয়া হয় না। তারপরও বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলেও মনে হয়; তোমরা ঠিক ক্রিকেটটা বুঝতে চেষ্টা করো না। ক্রিকেটার নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যত কথা বলেন, ক্রিকেট নিয়ে তার অর্ধেকও বলেন না! যেমন; তোমাদের রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যতো কথা বলেন, তার রাজনীতি নিয়ে ততোটা ভাবেন না। ভাবতে চান না!’ শুনতে অপ্রিয় লাগলেও সেদিন দিল্লির অবাঙালি বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম তাঁর উপলব্ধি এবং পর্যবেক্ষণের জন্য।
গত এক মাস ছিল বাঙালির শোকের মাস। এই সময়টা জুড়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেকে অনেক কথা বলেছেন। টোয়েন্টি ফোর সেভেন জমানায় কথা বলেই কাভারেজ পাওয়া যায়। তাহলে কথা বলবেন না কেন? কিন্তু সেই কথায় খুঁজে পাওয়া যায়নি, বাঙালির জীবনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব। সময় এসেছে বঙ্গবন্ধুকে নতুনভাবে খোঁজার। বোঝার। সেটা শুধু রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস,সাহিত্য, ক্রীড়ায় নয়। সর্বত্র। সব কিছুতে।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট এবং কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর