‘জামাই আদরে’ থাকা রোহিঙ্গারা কেন ফিরবে?
কক্সবাজারে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুকের বাবা তার নিজস্ব ১৪ একর জমিতে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর ফারুক বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তুলে দিয়েছিলেন খাবার। সেটি দু’বছর আগের কথা। কিন্তু গেলো ২৩ আগস্ট রোহিঙ্গাদের হাতে খুন হতে হয় তাকে। এটাই কি মানবিকতা? উপকারের প্রতিদান?
এমন অনেক ঘটনায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে ধৈর্য্য হারিয়েছে কক্সবাজারবাসী। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করে, খাবার আর আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল কক্সবাজারের মানুষ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ায় সব বয়সী মানুষের মধ্যেই উদ্বেগ আর রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। এটি হওয়ার পেছনেও যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে যেমন অভিজ্ঞতা শুনি সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের সহ্য করা কঠিনই বটে! কারণ রোহিঙ্গারা যে ‘জামাই আদর’ পাচ্ছে তাতে মনে হয় না তারা সহজে ফিরবে!
সেকথা স্বীকার করে স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গারা আর আরাম আয়েসে থাকতে পারবে না। কিন্তু তাদের আচরণ, কর্মকাণ্ড আর উগ্রবাদিতায় বাংলাদেশের বুকে একখণ্ড ‘মিয়ানমার’ যেন তৈরি করেছে তারা। ২৫ আগস্ট বিশাল সমাবেশ করে ইতোমধ্যে তারা নিজেদের বিশালতা সম্পর্কে জানান দিয়েছে। একইসঙ্গে ফিরে যেতে নানা শর্ত আরোপ করে তারা জানান দিয়েছে তাদের শক্তি সম্পর্কেও। অথচ গেলো দু’বছরে তারা আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে তা পূরণ হওয়ার নয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর প্রাথমিকভাবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দারাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের। মানবতার খাতিরে যতটুকু সম্বল ছিল তা দিয়েই অসহায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আশ্রয় দিতে গিয়ে আমাদের এমন সব ক্ষতি হয়ে গিয়েছে যেটি আর পূরণ করা সম্ভব নয়।
অপরাধ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, পরিবেশ বিপর্যয় এবং সংক্রমক ব্যাধিতে দিনদিন পুরো কক্সবাজারসহ সারাদেশেকেই যেন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে তারা। ইয়াবা ও মানবপাচার, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং, মারামারিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। কোনও কোনও ক্যাম্পে অস্ত্রের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, চাকরি দেওয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, এমনকি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরি করছে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ।
তাছাড়া হাজার হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। পাহাড়ি জমি, ক্ষেত, চাষের জমি নষ্ট হয়ে গেছে। পাহাড় ও সংরক্ষিত বন কেটে বানানো হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসতি। স্থানীয়দের একশো একরের বেশি কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে, কাটা হয়েছে চারশো কোটি টাকার গাছ, আর প্রতিদিনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৭৫০ মেট্রিকটন বনের গাছ। অনেকের জায়গা দখল হয়ে গেছে। জীবনযাত্রায় ঘটেছে ব্যাঘাত।
এছাড়া স্কুল, কলেজও বন্ধ রয়েছে মাসের পর মাস। এ পর্যন্ত এইডস আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে কয়েক দশক আগে বাংলাদেশ থেকে নির্মূল হওয়া ডিপথেরিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাকটেরিয়াঘটিত এই রোগ অত্যন্ত মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ। কক্সবাজারের ডিফথেরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণ। বা
চ্চা উৎপাদনের এদের জুড়ি মেলা ভার। খাওয়া আর বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই এদের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, এই বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য গত দুই বছরে বাংলাদেশ সরকারের খরচ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। রোহিঙ্গাদের পেছনে প্রতি মাসে সরকারের খরচের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা। এসব কারণে স্থানীয়রা হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। ইউএনডিপির এক গবেষণা বলছে, বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারে আসার পর রোহিঙ্গাদের প্রতি বেশ সহানুভূতি দেখিয়েছিল স্থানীয় মানুষ। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের প্রতি মানুষের মনোভাব বদলে গেছে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্র্যাকের এক গবেষণায় স্থানীয় পাঁচ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলের জরিপে তা বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তাই সাধারণ মানুষ মনে করেন, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইবে না। কারণ রোহিঙ্গারা তাদের চেয়ে সুখে আছে। এই আরাম আয়েশ ছেড়ে তারা আবার মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে যেতে চাইবে না। এর মধ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে বেশ কিছু এনজিও। তারা চাচ্ছে রোহিঙ্গারা থাকুক। তাতে তাদের আয়- রোজগার ভালোই।
ইতোমধ্যে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ভিত্তিক অনেক এনজিও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। দেশি বিদেশি ইন্ধনের কারণেই হয়তো রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। কিন্তু মনে হয়, সময় এসেছে তাদের প্রতি কঠোর হওয়ার। তারা এদেশের মাটিতে বসে আন্দোলন করছে, কিন্তু তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে হবে সেদেশের মাটিতে গিয়ে। তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি দেখবে মিয়ানমার। আমাদের দেশ নয়। বছরের পর বছরতো আমরা বোঝা টানতে পারি না। প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে, বিশ্বকে বোঝাতে হবে এদের কারণে আমাদের ক্ষতিটা কতোটুকু।
যেসব প্রতিক্রিয়াশীল এনজিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখছে প্রয়োজনে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। এদের দমাতে না পারলে প্রত্যাবাসন আরো কঠিন হবে। রোহিঙ্গাদের সুযোগ সুবিধা কমাতে হবে। আমাদের সরকারের মন্ত্রীরা এখনো যে মানবিকতার বার্তা দিয়ে যাচ্ছে তা থেকে সরে আসতে হবে। কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার সময় এসেছে। ‘জামাই আদর’ কমিয়ে দিলেই ‘জামাই’ সুর সুর করে বাড়ি ফিরে যাবে। নইলে নিজ ভূখণ্ড হারিয়ে একখণ্ড স্বাধীন ‘মিয়ানমার’ দেখতে আর হয়তো বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না দেশবাসীকে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/পিআর