শাড়ি কাহিনি
আমার এক পরিচিত নারীর গল্প দিয়েই না হয় শুরু করি। আমার সঙ্গে যখন তার আলাপ হয় মেয়েটির বয়স তখন ২৭ বা ২৮। বিয়ে হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়। তারপর লেখাপড়া চালিয়ে গেছে এবং ভালোভাবে স্নাতকোত্তরও করেছে। দেখতে সুন্দর। পরনে শাড়ি। কথায় কথায় বললেন, শাড়ি পরা ছাড়া তার গতি নেই। কী রকম? তার স্বামী তাকে শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকে দেখতে নারাজ। কেন? মেয়েটি দেখালেন তার পায়ে বেশ উঁচু হিল। হ্যাঁ তার উচ্চতা গড়পরতা বাঙালি নারীর চেয়ে কিছুটা কম।
স্বামী তাকে বলেছেন, সর্বদা উঁচু হিল এবং শাড়ি পরে সেই হিল ঢেকে রাখতে। যাতে এই বিভ্রম হয় যে, তার স্ত্রী তত খাটো নয়। তা এই হিল এবং শাড়ি পরে বেড়াবার জন্য তার স্বামী কি সার্বক্ষণিক গাড়ির ব্যবস্থা এবং পরবর্তীকালে হাড় ও গোড়ালির ব্যথার (আরও অনেক সমস্যার) নিদান দিয়ে রেখেছেন? না, তা নয়। এই শাড়ি পরা নারীকে নিয়ে তিনি প্রচণ্ড ভিড়ের যানবাহনে চড়ে ঈদের ছুটিতে প্রত্যন্ত গ্রামে যান এবং স্ত্রী তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে না পারলে গালিগালাজ ও মুখ ঝামটা দেন।
রমনা পার্কে স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে গেলেও শাড়ি ও হিল থাকা চাই। নইলে ওই ‘বেঁটে’ নারীকে নিয়ে তার লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। বাড়িতেও যতক্ষণ তিনি থাকবেন ততক্ষণ শাড়ি ও রণপা পরেই থাকতে হয় মেয়েটিকে। একবার দৈবাৎ সালোয়ার-কামিজ পরায় তিনি রাগ করে সবগুলো থ্রিপিস ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন। মেয়েটি বলেন, ‘আর পারছি না। পায়ে ব্যথা হয়ে গেল। আর এই শাড়ি পরে এত কাজ, বাচ্চার স্কুলে দৌড়ানো, বাসে চড়া, খুব ঝামেলার’।
পরে সেই সুশীলা নারী স্বামীর মুখ ঝাপটা এবং প্রহার সহ্য করতে না পেরে শাড়ি, উঁচু হিল এবং রাগী স্বামী তিনটাতেই ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে তার সঙ্গে দেখা হলো, ফ্ল্যাট স্যান্ডেল, সালোয়ার-কামিজ এবং নতুন জীবনসঙ্গী নিয়ে তার জীবন বেশ ভালোভাবেই কাটছে।
আবার এর বিপরীত গল্পও আছে। শাড়িতে নাকি ‘পর্দা’ হয় না। তাই স্ত্রীকে শাড়ি পরতে দিতেন না এক স্বামী। নিমন্ত্রণ বাড়িতেও সালোয়ার-কামিজ নয় তো শাড়ির উপরে সৌদি বোরকা।
এই দুটো ঘটনার উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, নারীর পোশাকের ওপর মাতব্বরি বা নিয়ন্ত্রণকামিতা পুরুষতন্ত্রের খুব পুরনো একটি হাতিয়ার, যা এখনও চালু রয়েছে। নারী কী পরবে, কোন পোশাকে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে তা একান্তভাবে তারই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।
এবার আসি শাড়ি প্রসঙ্গে। শাড়ি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক। খুব সুন্দর পোশাক সন্দেহ নেই। এ কথাও ঠিক যে, বাঙালি নারীকে শাড়িতে খুবই সুন্দর লাগে। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, পালা-পার্বণে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে শাড়িই হতে পারে বাংলাদেশের মেয়েদের পরিধেয়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে, যেখানে কল-কারখানায়, মাঠেঘাটে কাজ, যেখানে বাসে, ট্রেনে চলাচল, যেখানে বাইক চালাতে হয়, দৈহিক শ্রম করতে হয় সেখানে শাড়ি খুব স্বাচ্ছন্দ্যের পোশাক কি? আমি নিজে অন্তত এ পোশাকে কঠিন পরিশ্রম করতে পারি না।
যেকোনো উৎসবে, সেমিনারে, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার যেকোনো অনুষ্ঠানে আমি অবশ্যই শাড়ি পরি। কিন্তু যখন হাটে-বাজারে যাই, পাহাড়ে চড়ি, সাগর-সৈকতে যাই কিংবা যেকোনো দূরপাল্লার ভ্রমণে আমি কখনও শাড়ি পরি না। তখন বরং জিন্স, শার্ট-প্যান্ট, ওভারকোট ইত্যাদি। এই তো সেদিন এক ম্যারাথনে যোগ দিলাম। দুই ঘণ্টার মধ্যে ১০ কিলোমিটার দৌড়। শাড়ি পরে দৌড়? মাথা খারাপ? অবশ্যই ট্র্যাকস্যুটে। অন্যান্য দেশের নারীদেরও দেখেছি ঐতিহ্যবাহী পোশাক তারা পরেন উৎসবে বা কোনো অনুষ্ঠানে। কাজের সময় স্বাচ্ছন্দ্যকেই প্রাধান্য দেন সকলে।
এবার আসি শারীরিক উচ্চতার প্রসঙ্গে। সম্প্রতি একটি বহুল আলোচিত লেখায় একজন লেখক বাঙালি নারীকে খর্বকায় বলে উল্লেখ করেছেন। এও বলেছেন, বাঙালি নারীর উচ্চতা যেহেতু অনেক কম (উত্তর ভারত ও অন্যান্য দেশের মেয়েদের তুলনায়) তাই একমাত্র শাড়ি পরলেই তার বাঁচোয়া। অন্যথায় তাকে বড়ই কুশ্রী দেখাবে (পুরুষের চোখে)। আরও বলেছেন যে, বাঙালি পুরুষের উচ্চতাও কম। কিন্তু দৈহিক সৌন্দর্য নাকি ছেলেদের জন্য বড় ব্যাপার নয়, তাই তারা এতে আটকে যায় না। ‘আটকে যায় মেয়েরা।’
কে কেন কোথায় আটকায় তা অবশ্য আমার বোধগম্য নয়। দৈহিক সৌন্দর্য কেন ছেলেদের জন্য ‘বড় ব্যাপার নয়’ এবং বেচারি মেয়েরাই কেন দৈহিক সৌন্দর্যের একমাত্র ভার বহনকারী তাও আমি বুঝতে অক্ষম। সেসব বস্তাপচা আলোচনায় আমি যেতেও চাই না। তিনি আরও বলেছেন, বাঙালি নারী পাশ্চাত্যের পোশাক পরে নিজেদের পাশ্চাত্যের নারীদের সমকক্ষ (সৌন্দর্যে) ভেবে নাকি হাস্যকর আত্মতৃপ্তি পায়।
হ্যাঁ, বাঙালি নারীর গড় উচ্চতা অবশ্যই জার্মান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নারীর তুলনায় কম। কিন্তু সেই অপরাধে (?) তাকে যাবজ্জীবন শাড়ির ১২ হাতি প্যাঁচে আটকে থাকতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি? তার ইচ্ছা হলে সে শাড়ি পরবে, ইচ্ছা হলে পাশ্চাত্য পোশাক পরবে। শাড়িতে বাঙালি নারীকে সবচেয়ে আবেদনময়ী দেখায়। যেহেতু সে ‘বেঁটে’ তাই অন্য পোশাকে তাকে বিশ্রী দেখায়। তাই সে অন্য পোশাক না পরে শাড়ি পরবে। বাহ। কী সুন্দর পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা। পুরুষের প্রতি এত শ্রদ্ধা ভক্তি তো শাবানাও দেখাতে পারেননি। কিন্তু বাঙালি নারীর কি আর কোনো কাজ নেই?
পুরুষের চোখে মোহনীয়, আবেদনময়ী হতে পারলেই তার জীবন সার্থক। ঝাঁটা মারি এমন জীবনের মুখে। আর শাড়ির নিচে হাইহিল পরে নিজেকে লম্বা দেখানোর চেষ্টা? কেন রে? হাইহিলে পেলভিক বোন, মেরুদণ্ড, গোড়ালির হাড় সবকিছুর ওপর যে চাপ পড়ে তার বিষময় ফল সুদূরপ্রসারী। চলাফেরায় অসুবিধার কথা না হয় বাদই দিলাম। আর লম্বাই যদি সৌন্দর্যের একমাত্র মাপকাঠি হতো তাহলে প্রাণীকূলে জিরাফের চেয়ে রূপবান আর কেউ হতো না। সবচেয়ে বড় কথা দৈহিক দৈর্ঘ্য নয়, চেষ্টা থাকা উচিত (নারী-পুরুষ সবারই) মানসিক উচ্চতা বাড়ানোর। ‘শারীরিক উচ্চতার কারণে বাঙালি নারীর চেয়ে অন্য দেশীয় নারীরা অধিকতর সুন্দরী’, ‘খর্বাকৃতিরা অসুন্দরী’, ‘দীর্ঘাঙ্গীরাই সুন্দরী’ এগুলো খুবই ভোগবাদী চিন্তা।
নারীর শারীরিক উচ্চতা নিয়ে ‘আমার মুক্তি একজোড়া কেডস’সহ বিভিন্ন লেখায় অনেকবার অনেক কথা লিখেছি। তাই এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করলাম না। বিশ্বখ্যাত সুন্দরী ক্লিওপেট্রা ছিলেন খর্বাকৃতি। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদের একাংশের মতে তার উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুটের অনেক নিচে। কিন্তু তিনি ক্ষমতায়িত নারী ছিলেন। তাই একালেও তার রূপের খ্যাতি কম নয়। আর মননের দিক থেকে ঋদ্ধ, স্বাধীন, নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার অধিকারী, অন্তত তার জন্য সংগ্রামশীল, বুদ্ধিমতী, সৃষ্টিশীল নারীই (পুরুষও তাই) সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। বিউটি প্রকৃতপক্ষে ব্রেইনে, দেহে নয়।
আর কে লম্বা, কে বেঁটে, কে সুন্দরী, আকর্ষণীয়, আর কে অসুন্দরী এসব ভাবনার দিন গত হয়েছে বহু আগেই। শাড়ি পরে পটের বিবি সেজে দিন গুজরান করার মতো সময়ও এখন নারীর হাতে নেই বললেই চলে। তাই বলে বাঙালি নারী যে শাড়িকে বিদায় করেছে তা কিন্তু নয়। উৎসবে অনুষ্ঠানে এখনও শাড়িই চলে। কিন্তু জীবন জীবিকার ব্যস্ততায় সময়ের পাল্লা ধরতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন রকম পোশাক বেছে নিচ্ছি। তা নেয়ার পূর্ণ অধিকার আমাদের রয়েছে। পুরুষও কি তাই করেনি? ধুতি পাঞ্জাবি, পাজামা-পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, প্রিন্স কোট এসব পরলে তো পুরুষকে বেশ কার্তিক কার্তিকই লাগে। টাক্সিডো, থ্রিপিস সুট ইত্যাদি পরা পুরুষেরও আকর্ষণ যথেষ্ট। কিন্তু কাজের প্রয়োজনে লপেটা বাবু সাজা বাদ দিয়ে পুরুষ তো দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যের পোশাক বেছে নিয়েছে। হ্যাঁ, উৎসব-অনুষ্ঠানে তারাও ঐতিহ্যবাহী পোশাক বা ইভনিং সুট পরে বৈকি। শাড়িও তেমনি।
এক কথায় বলতে গেলে, আমি শাড়িবিরোধী নই। কিন্তু শাড়ি পরে পুরুষের নয়নমোহিনী হওয়ার যে চেষ্টা সেই মানসিকতারবিরোধী। আর শাড়ি পরা বাঙালি নারীর যৌন আবেদন এবং পাশ্চাত্যের পোশাক পরা খর্বাকৃতি বাঙালি নারীর যৌন আবেদনে ঘাটতি ইত্যাদি নিরর্থক আলোচনা আমার মনে হয় চিন্তার দৈন্যতা ও পুরুষতান্ত্রিক পশ্চাৎপদ মানসিকতাকেই প্রকাশ করে তার বেশিকিছু নয়।
বিএ/এমকেএইচ