একটি ভার্চুয়াল বিপর্যয়ের গল্প আর ধন্য ছাত্রলীগ মম!
একটা ইআরসিপি সবে মাত্র শেষ হয়েছে, আরেকজন রোগীকে ইআরসিপির টেবিলে তোলার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত এন্ডোস্কপি এসিস্টেন্টরা। মাঝে কিছুটা সময়। অভ্যাস বসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফেসবুকে ক্লিক করতেই একটা অচেনা মেসেজ, ‘ইওর সেশন হ্যাজ এক্সপায়ার্ড’। ম্যাসেঞ্জারে ক্লিক করলাম, সেই একই মেসেজ। প্রথমে মজেজাটা বুঝিনি। পাসওয়ার্ড দিয়ে ক্লিক করতে গিয়ে বুঝলাম কোথাও কোনো ঝামেলা হয়ে গেছে। কিছুতেই ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছে না। নিজের অতি চেনা ফেসবুকের কাছে আমি নিজেই অচেনা। তারিখটা আগস্টের ২৪, ঘড়িতে সময় রাত ০৮:২৬।
কোনো কিছু ঠাওর করে ওঠার আগেই টেবিলে পরের রোগী। অগত্যা ফেসবুক ছেড়ে ইআরসিপিতে মন দিতে হলো। দ্বিতীয় ইআরসিপিটা শেষ হওয়ার আগেই শুভানুধ্যায়ীদের অনেক ফোনে আমার বোঝা শেষ যে আমার ফেস বুকিংয়ের এটা আপাত সমাপ্তি। হ্যাকড হয়েছে আমার অতিসাধের ফেসবুক একাউন্টটি। এরই মাঝে চেম্বারে চলে এসেছে প্রিয় ছোট ভাই ডা. সুনান। কম্পিউটার নাড়াচাড়ায় রীতিমতো বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে তাকে। নিশ্চিত করলো একাউন্ট আর নেই। নির্দয় হ্যাকার ডিলিট করে দিয়েছে আমার প্রিয় ফেসবুক আইডিটি।
গভীর রাত পর্যন্ত ডা. সুনানের সব চেষ্টা আপাত ব্যর্থ। আপাতত হ্যাকার মহাশয় আমাদের গোল দিয়ে দিয়েছে। শরণাপন্ন হলাম কিছু পরিচিত সরকারি-বেসরকারি বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীর। এরই মাঝে সহধর্মীণী ডা. নুজহাতের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কল্যাণে অনেকেই জেনে গেছেন আমার ফেসবুক বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত। গভীর রাতে অসংখ্য মেসেজে ভারাক্রান্ত নুজহাতের ইনবক্স। দেশের নানা এলাকা থেকে তো বটেই, এমনকি পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বন্ধু আর শুভানুধ্যায়ীরা পরামর্শ আর সহানুভূতি জানাচ্ছে।
একাউন্টটা হ্যাক হওয়ার পর থেকেই অভ্যাসবশে প্যান্টের পকেটে হাত চলে গেছে বার বার। হাতে উঠে এসেছে সেলফোন। কিন্তু ফেসবুকে ক্লিক করতেই মনে পড়েছে, ‘ওহ হো!’ কিছু একটা নাই, কিছু একটা নাই, এমন অনুভূতি হচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকেই। কি-ই যে নাই তা ক্রমেই বুঝতে পারছি। বিশেষ করে রাতে বাসায় ফেরার পর থেকেই। নিজের জন্য কি খারাপ লাগবে? খারাপ লাগছে বেচারা সেলফোনটার জন্য। বেচারা সেলফোটনাকে বড্ড নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।
সকালে সম্প্রীতি বাংলাদেশের ডেঙ্গু সচেতনতা কর্মসূচি। অনুষ্ঠানে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন। থাকছেন নামি-দামি বুদ্ধিজীবীরাও। থাকবেন এমনকি উত্তর সিটির নগরপিতা। সাথে স্থানীয় এমপি মহোদয়ও। একটু আগেভাগে গিয়ে গোছগাছের ব্যাপার তো থেকেই যায়। ছুটলাম তাই তাড়াতাড়ি। হাজার হোক সংগঠনের সদস্য সচিব বলে কথা। কিন্তু কোথায় যেন একটা ছন্দপতন। কোথাও একটা বিশাল শূন্যতা। আবার নিজের ওপর রাগও হচ্ছে মাঝে মাঝে। নিজেকে অনেকটা এডিক্টের মতো লাগছে। নিজেই তো টিভিতে ফ্যাটি লিভার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনলাইন এডিকশন নিয়ে কত বড় বড় কথা বলি। ছেলেপুলেকে ভার্চুয়াল প্লেগ্রাউন্ড ছেড়ে পাড়ার মাঠে খেলতে উৎসাহিত করি। অথচ নিজেই কখন যেন নিজের অজান্তে ভার্চুয়াল এডিক্ট হয়ে গেছি টেরই পাইনি।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের অনুষ্ঠানটা আরম্ভ হয়ে গেছে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বাগত বক্তব্য রাখছি। মনের কোনে চিনচিনে একটু ব্যথা। বরাবরের মতোই সম্প্রীতি বাংলাদেশের অনুষ্ঠানটা ফেসবুকে লাইভ হচ্ছে, কিন্তু তা শেয়ার করার জন্য আমার ওয়ালটা কোথায়? হ্যাকার মশাই তো আমার একাউন্টটাই ডিলিট করে দিয়েছেন। অনেক রকম পরামর্শ পাচ্ছি। কি করা উচিত আর কি না। থানায় জিডি করবো না করবো না ইত্যাদি, ইত্যাদি। স্বাগত বক্তব্য দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওই একটাই চিন্তা। মনটা উদাস। আমি আছি ঠিকই, কিন্তু আমার মন নেই সম্প্রীতি বাংলাদেশের আজকের এই আয়োজনে। কেউ কেউ বলছেন একাউন্ট ফিরে পাওয়ার আসা সামান্যই। কেউ কেউ আবার বলছেন পাবো ঠিকই, কিন্তু অনেক দেরিতে আর থাকবে না একাউন্টের অনেক কনটেন্টই। বক্তব্য রাখছি আর ভাবছি সাইবার ক্রাইমের কাউকে চিনি কিনা। বার বার মনে পড়ছে ঢাকা কলেজের বন্ধু সুপারস্টার পুলিশ কর্তা মনিরুলের কথা। সকালেই তাকে টেক্সট পাঠিয়েছি। উত্তর দেয়নি এখনো।
স্বাগত বক্তব্য শেষ হতে হতে অনুভূতিগুলো কেমন যেন বদলে যেতে থাকলো। কেমন একটা মুক্তির আনন্দে বিভোর যেন আমি। অনেক দিন পর একটা বন্ধনহীনতার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন যেন আমি। নেই কোনো পোস্ট দেয়ার তাগাদা। একটু পর পর ফেসবুকে ঢুকে এর ওর স্ট্যাটাস ঘাঁটার আর লাইক দেয়ার তাগাদাও নেই। নেই কি বললাম আর কে কি মনে করলো নিয়ে ভাবনা চিন্তার প্রয়োজনীয়তাও। দারুণ তো! এমনটা তো আগে বুঝিনি। নিজের অজান্তেই কখন যে নিজেকে প্রযুক্তির কারাগারে সমর্পণ করেছি আগে ভাবিনি। সেভাবে ভাবার সুযোগও তো হয়নি আমার ফেসবুকিংয়ের চার বছরের সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে।
আনন্দের মাত্রাটা ক্রমশ বাড়ছে আরেকটা কারণে আমার ভার্চুয়াল বিপর্যয়ের দুঃখবোধ কমিয়ে দিচ্ছে অনেকগুলো এসএমএস আর ফোন কল। মনিরুল মাত্রই টেক্সট পাঠিয়েছে। সে দেশের বাইরে। এই মুহূর্তে ট্রানজিটে। তার পরও আমার টেক্সট পেয়ে জুনিয়র কলিগকে অনুরোধ করেছে আমাকে সাহায্য করতে। মনে ভালো লাগার জোয়ার বইছে সাবেক ছাত্রলীগার কিছু তরুণ তুর্কির নিঃশর্ত ভালোবাসায়ও। এরা এখন কেউ আইটি কাপায়, তো কেউ দাপায় অনলাইন। প্রত্যেকে যার যার জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। সঙ্গত কারণেই ব্যস্ততাও অনেক তাদের। অথচ এরাই নুজহাতের স্ট্যাটাসে আমার ফেসবুক বিপর্যয়ের খবর পেয়ে সব কাজ এক পাশে সরিয়ে সকাল থেকে কোমড় কষে নেমেছে।
ডিনারের আগে হ্যাক হওয়া একাউন্ট তারা লাঞ্চের আগে ফিরিয়ে এনেই ছাড়বে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে, আবার করছেও না। প্রতি মুহূর্তে ফোন আর এসএমএস পাচ্ছি তাদের কাছ থেকে। এখন অমুক পাসওয়ার্ডটা দেন তো তখন তমুক কোডটা। এহেন ডিজিটাল উত্তরসূরিদের সাথে তাল মেলানোর সামর্থ্য পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এই আমার কোথায়? ভরসা ছোট ভাই ডা. সুনান। সকাল থেকেই সাথে আছে। একবারও ডাকতে হয়নি, বলতে হয়নি ‘আয়’। পাশে বসে ল্যাপটপ নিয়ে কোঅর্ডিনেট করে চলেছে ঢাকার অন্য প্রান্তে ওদের সাথে। আনন্দে বুকটা ভরে উঠছে আমার। সাবেক এই ছাত্রলীগাররা বড় ভাইয়ের হয়ে এই লড়াইটা না জিতে কাজে ফিরবে না পন করেছে যেন। পাশাপাশি গর্বও হচ্ছে অনেক- এই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ।
এই যখন চলছে আমার আশপাশের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে, আমি তখন ছুটছি আমার পরবর্তী গন্তব্য এটিএন নিউজে। সকালে হঠাৎই ফোনে ছোট ভাই প্রণব সাহার নির্দেশ, ‘বদ্দা, দুপুরে চলে এসেন হ্যাপেনিং পয়েন্টে’। এটিএন নিউজের লাইভ শেষে বের হয়ে সেলফোনটা অন করতে না করতে এর রাশ মেসেজে ফোন ভারাক্রান্ত। কথা রেখেছে তরুণ তুর্কিরা- লাঞ্চের আগেই রিকভারি করেছে আমার হ্যাকড একাউন্টটি। এখন তারা শত ব্যস্ত উদ্ধার করা একাউন্টটা সিকিওর করায়। তাড়াতাড়ি নানা পাসওয়ার্ড, ফটো আইন্ডেটিফিকেশন আর কোড চেয়ে তাই একের পর এক এসএমএস পাঠাচ্ছে তারা।
ষোল ঘণ্টার স্বাধীনতা শেষে আবারো ভার্চুয়াল কারাগারে আত্মসমর্পণ আমার। তবে দুঃখ নেই তাতে এতটুকুও। সানন্দেই ফিরে যাচ্ছি ভার্চুয়াল ব্যস্ততায়। তবে কেন যেন একটু করুণাবোধ হচ্ছে। করুণা হচ্ছে বেচারা হ্যাকারের জন্য। সাবেক ছাত্রলীগার তরুণ তুর্কিরা বলছে হ্যাকার নাকি প্রফেশনাল। অনেক মেধা আর শ্রমে, অনেক সময় ব্যয় করে বেচারা আমার একাউন্টটা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। ডিলিটও করে দিয়েছিল। আমার একাউন্টটা যখন উদ্ধার হচ্ছে তখনও মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল আবারো হ্যাক করার, পারেনি। গোল দিয়েছিল বটে, কিন্তু লিডটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। শেষমেশ গোহারা হারতে হয়েছে। বেচারার জন্য করুণা না করে উপায় আছে? কেন যেন মনে হচ্ছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতার একটা ক্ষুদ্র মঞ্চায়ন হয়ে গেল। কখনো কল্লাবাজি তো কখনো চামড়া বাজি- চেষ্টা তো কম হলো না। ফলাফলটা কিন্তু বার বারই ওদের বিপক্ষে যাচ্ছে।
গাড়ি যখন ছুটছে এয়ারপোর্ট রোড ধরে, আমি তখন একটু নস্টালজিক। মনে পড়ছে বহুদিন আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের দিনগুলোর কথা। নব্বইয়ের পর তখন দেশে তথাকথিত গণতন্ত্রবাজি চলছে। হোস্টেল থেকে বিতারিত হয়ে আমরা একদল ছাত্রলীগার ব্রাহ্মপল্লী আর কেস্টপুরের ছোট ছোট ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে একাট্টা। একসাথেই পাড়ি দিয়েছি কঠিন সময়গুলো। মার খেয়েছি, দৌড়িয়েছি, প্রফেশনাল পরীক্ষার হলে ছাত্রদলের বন্ধুদের ছুরিকাঘাতে হারিয়েছি প্রিয় বড় ভাই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাইসুল হাসান নোমান ভাইকেও। তবুও ভুলিনি ‘জয় বাংলা’কে, ছাড়িনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। শেষমেশ জয় আমাদেরই হয়েছে আর ওরা ছিটকে পড়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।
পরের গন্তব্য যখন ছুঁই ছুঁই আমার কিন্তু তখন হ্যাকারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। কে আমি? নইতো তেমন কেউ-কেটা। ধন্যবাদ আমাকে হ্যাক করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যে আমার ফেসবুকিংয়ের জায়গাটায় আমি ঠিকঠাক মতোই আছি! ধন্যবাদ আমাকে আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য যে আমরা বিজয়ীর জাত, জয়ী হওয়াটাই আমাদের মজ্জাগত। আমরা হারতে পারি, তবে সেটা সাময়িক। আমরা ফিরবো, একাট্টা হয়ে পাল্টা লড়বো এবং আমরা জিতবই।
সবশেষে ধন্যবাদ আমাকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে আমার গর্বের জায়গাটা আমার শেকড়- আমার গর্বের জায়গাটা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ধন্য ছাত্রলীগ মম!
লেখক : অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস