এরপরও ডাক্তাররা কসাই?
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১২:৪৬ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০১৯
এবার ডেঙ্গুর চিকিৎসারত অবস্থায় ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের একেকটি মৃত্যু মালিকুল মউতের হৃদয়ে কম্পন জাগিয়েছে কি-না, কে জানে? তবে, সুস্থ-বিবেকবানদের কষ্ট দিয়েছে। ভাবিয়েছে। সারা দেশে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর তালিকা থেকে বাদ যাননি চিকিৎসক-নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও। এক হিসাবে জানা গেছে, ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের এ সংখ্যা সাড়ে তিন শতের মতো।
এরপরও ডাক্তারদের ‘কসাই’ বলে গাল দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা। বলেছি, বলছি, বলবো-র মতো গাল দিয়েই যাচ্ছি। এর একটা প্রেক্ষিত বা কারণ অবশ্যই রয়েছে। অন্যদিকে, জীবনরক্ষায় সর্বসাধ্য চেষ্টার পরও এ গাল শোনা অনেকটা নিয়তির মতো হয়ে গেছে ডাক্তারদের জন্য। তারা যেন হজম বা সহ্য করতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এর মাঝেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন তারা।
একজন সিভিল সার্জনসহ মারা গেছেন সাতজন চিকিৎসক, দুজন নার্স ও একজন স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসক ১০৪ জন। নার্স ১৩৬ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ৯০ জন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালের ১৮৮ এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্টাফ আক্রান্ত হন ১৪২ জন।
বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো চিকিৎসা চলছে ডাক্তার-নার্সসহ বেশ ক’জন স্বাস্থ্যকর্মীর। ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচিতে ঢাকায় এসে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবসে মাদারীপুরের স্বাস্থ্য সহকারী তপন কুমার মন্ডলের মৃত্যুর সংবাদ বড় করুণ। এর বাইরে বিভিন্ন তারিখে ডা. নিগার নাহিদ, ডা. শাহাদাত হোসেন, ডা. তানিয়া সুলতানা, ডা. উইলিয়াম ম্রং ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে বেড়াতে আসা ডা. রেহানার মৃত্যু আমাদের স্বাস্থ্যবিভাগের জন্য দাগ কাটা ঘটনা।
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যরা এবারের ঈদেও ছুটি পাননি। তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও দিন কাটছে চরম ঝুঁকিতে। ডেঙ্গুতে স্বজনও হারিয়েছেন তাদের কেউ কেউ। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের শিশু হাসপাতালে মারা যাওয়া রাজ চৌধুরী নামের শিশুটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. নির্মল কান্তি চৌধুরীর ছেলে।
সরকারের দিক থেকে বাস্তবতা অস্বীকারের প্রবণতায় গা ভাসাননি ডাক্তাররা। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তাররা ঢাকার রোগী সামলিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসায় তারা আরও নাস্তানাবুদ হয়েছেন। আবার ঢাকা থেকে বাইরে যাওয়া ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়ার বাড়তি বোঝা টেনেছেন মফস্বলের ডাক্তাররা। বাংলাদেশের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। ভুল চিকিৎসা, অপারেশনের পর পেটের ভেতর ছুরি-কাচি, সুই-সূতা রেখে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। ধর্ষণের অভিযোগও বাদ নেই। সব মিলিয়ে তাদের ললাটে ‘কসাই’ খেতাবটা গেঁথে দেয়া হয়েছে।
রীতিমতো জনদুশমনের তালিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডাক্তারদের। এর জেরে মানুষ মন ভরে ডাক্তারদের গালি দেয়। ঢক মতো পেলে ডাক্তারদের পিটুনিও দেয়া হয়। এসবের তেমন বিচারও হয় না। টাকার বস্তা নিয়ে চিকিৎসা নিতে চলে যায় ভারত, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর। সুস্থ হয়ে ফেরার পথে ভালো মার্কেটিংও করে আসে। জ্বর সর্দি থেকে শুরু করে সিরিয়াস কিছু হলে চেনা-জানা ডাক্তারদের শরণাপন্ন হই। ওষুধ লিখিয়ে নিই। নয়তো কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলে ভালো চিকিৎসা মিলবে সেই বুদ্ধি নিই। কখনো কখনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন ক্রস চেক করিয়েও নিই। বেশিরভাগ সময় এসব কাজ আমরা করি বিনা ভিজিটে। এমন ক্ষেত্রে কোনো ডাক্তার ভিজিট নিতে চানও না।
স্কুল- কলেজের সবচেয়ে মেধাবীরা ডাক্তারী পড়তে যায়। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি, পড়াশোনা, এরপর কর্মসংস্থানে কতো দুর্ভোগ ডাক্তারদের? তা আমাদের অনেকের জানার বাইরে। শুরুতে কতো সামান্য বেতন বা হাজিরায় ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালে তারা গতর খাটেন অনেকের ভাবনায়ও আসবে না। বিসিএস বা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পোস্টিংয়ের জন্য একজন ডাক্তারকে কতো জায়গায় ধর্না দিতে হয়, কতো অযোগ্য-অসৎ-অশিক্ষিত ব্যক্তিকে সালাম-আদাব দিতে হয়?-ভুক্তভোগীরাই ভালো জানেন। তখন কোনো ডাক্তারের নিজের প্রতি ধিক্কার আসে। বছর খানেক আগের এক হিসাবে জেনেছি, দেশে ডাক্তার এবং রোগীর অনুপাত বড় নির্মম। ডাক্তার প্রতি রোগী ৬৫৭৯ জন।
সরকারি- বেসরকারি মেডিকেল কলেজে থেকে বছরে হাজার সাতেক ডাক্তার বের হচ্ছেন। সেই তুলনায় পোস্ট গ্রাজুয়েশনের সুযোগ নগণ্য। সেটা করতে গিয়ে ভোগান্তি জঘন্য পর্যায়ে।যারা সুযোগ পান তাদের কেন বছরের পর বছর ফেল করতে হয় জানলে মাথা ঘুরবে। এরপরও ঢালাওভাবে নেতিবাচক উপস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবায় নন্দ ঘোষের মতো সব দোষ ডাক্তারদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার এ সংস্কৃতির মধ্যে বাংলাদেশের ডাক্তারদের কয়েকটি চিকিৎসা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করেছে। জোড়া শিশুর মাথা কেটে আলাদা করা, মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুসহ মাকে সারিয়ে তোলা, আজব রোগী বৃক্ষমানবকে সুস্থ করে তোলার বিশেষ কৃতিত্ব বাংলাদেশের ডাক্তারদেরই। সবদিক ভেবে, প্লিজ! আমরা যেন ডাক্তারদের আর ভিলেন না বানাই। গালমন্দ থেকে একটু একটু করে সরে আসতে পারি।
ডাক্তারদের অবহেলা, দুর্ব্যবহারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অনেকের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে, এবারের ডেঙ্গু মড়ক বা দুর্যোগে তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় দ্বিতীয় ঈশ্বরের আসনে দেখা গেছে। ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর শত শত মানুষের হাসপাতালে ছোটাছুটি, ভর্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় ডাক্তার-নার্সদের পরিশ্রম গণমাধ্যমেও সেইভাবে আসেনি। মানুষের উপচেপড়া ভিড়ে হাসপাতালগুলোতে তাদের হিমশিম দশা শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় কাতর করে তুলেছে। রোগীদের সংকট মূহুর্তে ডাক্তারদের উদ্বেগ-আবেগ, সারিয়ে তোলার চেষ্টা-আকুতির কিছু ঘটনা নিজ চোখেও দেখা হয়েছে। রোগী ভালো হওয়ার পর কোনো কোনো ডাক্তারের আত্মতৃপ্তি স্বর্গসুখ উপলব্ধি করেছি।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যরা এবারের ঈদেও ছুটি পাননি। তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও দিন কাটছে চরম ঝুঁকিতে। ডেঙ্গুতে স্বজনও হারিয়েছেন তাদের কেউ কেউ। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের শিশু হাসপাতালে মারা যাওয়া রাজ চৌধুরী নামের শিশুটি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. নির্মল কান্তি চৌধুরীর ছেলে।