‘পৃথিবীর ফুসফুস’ পুড়ছে!
তিন সপ্তা ধরে পুড়ছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’। অথচ কোথাও কোন খবর নেই! ফুসফুস পুড়লে কষ্ট হয় না? কত কষ্ট হয়, তা আন্দাজ করে বুঝি, যার পোড়ে সে তারস্বরে কাঁদে কী না! কাঁদে। বিলাপ করে। বাঁচার আকুতি জানায়। আগুন নেভানোর জন্য আকুল আবেদন জানায়।
পৃথিবীর ফুসফুস পুড়ছে। পৃথিবী কি কাঁদছে? বিলাপ করছে বাঁচাও বাঁচাও বলে? আগুন নেভানোর জন্য কার কাছে সাহায্য চাইছে পৃথিবী? মানুষের কাছে নয়তো? হা মানুষ! মনে আছে, নটরডেম ক্যাথেড্রালে আগুন ধরেছিল। মিডিয়া প্রতি মিনিটে খবর জানাচ্ছিল আগুনের। পৃথিবীর ফুসফুসে আগুন ধরে গেছে, সে খবর কেন আসছে না মূল ধারার মিডিয়ায়? সোশ্যাল মিডিয়াতে #প্রে ফর আমাজনিয়া এবং #আমাজনফায়ার শিরোনামে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, পর্দার আড়ালে চলছে দীর্ঘশ্বাসের দৌড়। অথচ খবরের পেছনের খবর কিংবা বস্তুনিষ্ঠ খবর সবাইকে জানাতে গলদঘর্ম হওয়া সংবাদকর্মী-সংবাদ মাধ্যম কেন নীরব? রহস্য বটে!
আমাজনিয়া শব্দটি শুনে শিউরে উঠছেন নিশ্চয়ই। আমাজনিয়ার জন্য প্রে করতে হচ্ছে। কেননা, আমাজন রেইন ফরেস্ট পৃথিবীর অক্সিজেনের শতকরা বিশ ভাগ সরবরাহ করে, বায়ুমন্ডল থেকে শুষে নেয় বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তাই এর নাম দিয়েছেন ‘পৃথিবীর ফুসফুস’।
আমাজ রেইন ফরেস্টে দাবানল ছড়িয়ে পড়া শুরু হয় তিন সপ্তা আগে, জুলাই মাসের শেষ দিকে। এই আগুন নিভছে না। প্রতি মিনিটে তিনটি ফুটবল মাঠের সমান বনের এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বলিভিয়া সীমান্তবর্তী ব্রাজিলের রন্ডোনিয়া প্রদেশের প্রায় এক হাজার হেক্টর জমি পুড়ে গেছে। মাতো গ্রসো প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। ব্রাজিলের বেশ কয়েকটা শহরের আকাশ ঢাকা পড়েছে ঘন কাল ধোঁয়াতে। নাসার গবেষক সান্তিয়াগো গাসো ১৩ আগস্ট জানিয়েছেন, ১.২ মিলিয়ন বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বিমান চলাচল বাতিল করা হচ্ছে। মানুষ আর পশুপাখিদের স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনাটি।
২০১৬ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পরিবেশ সচেতন ব্রাজিল নানা আয়োজন করেছিল, মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জের বলসোনারো এখন একেবারে নিশ্চুপ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিষ্য বনে গেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয়কে গালগপ্পো মনে করা নেতাদের কাতারে ভিড়ে যাওয়া ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বন পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়াকে তেমন কোন ঘটনা বলে মনে করছেন না। এই ২০১৯ সালের আট মাসে ব্রাজিলের নানা বনে আগুন ধরেছে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই)-এর তথ্য মতে তিয়াত্তর হাজার দাবানলের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার।
শুকনো মওসুমে জঙ্গলে আগুন লাগানো শুরু হয়। অক্টোবরের শেষের দিকে বা নভেম্বরের শুরুতে এসে এই আগুন লাগার ঘটনা থেমে যায়। ফাঁকা জমিতে শুরু হয় শস্য চাষ। ফাঁকা জমি দখলের প্রতিযোগিতাও চলে। বন উজাড় হতে থাকে। তবে নাসা বলছে, আমাজনের জঙ্গলে স্যাঁতসেতে পরিবেশ থাকায় সহজে আগুন ধরানো যেত না। ঐতিহাসিকভাবেই এই জঙ্গল ছিল প্রাকৃতিকভাবে আগুন-প্রতিরোধী। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এই জঙ্গলও। এখন বেশ ঘন ঘন খরা হয়। মাটি শুকিয়ে যায়। গাছ কেটে ফেলার ফলে মাটির প্রকৃতি বদলে গেছে দিনে দিনে। ফলে আগুনও ধরছে সহজে এবং ঘন ঘন। তবে, আগুন নিজে নিজে ধরছে না। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার প্রোগ্রামের আমাজন প্রোগ্রাম ম্যানেজার রিকার্ডো মেলো বলে, শুরুটা মানুষই করেছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আমাজন এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আনে আলনেকার বলেছেন, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ব্যাপকভাবে খরা হলেও ২০১৯ সালে কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। আমাজনে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এল নিনোর মতো খরাসৃষ্টিকারী ঘটনাও ঘটেনি এ বছর। কাজেই, এই আগুনের কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক কোন ঘটনাকে দায়ী করা যাচ্ছে না।
ব্রাজিল কি আগুন নেভাতে পারছে না? জার্মান চ্যান্সেলর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্রাজিলের বনজ সম্পদ রক্ষার্থে ফান্ড দিতে চেয়েছেন। ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট স্রেফ নাকচ করেছেন প্রস্তাব। বলেছেন, আমার দেশের জন্য এর দরকার নেই। পাল্টা জবাবে জার্মান ব্রাজিলের বনজ সম্পদ রক্ষার্থে সেই ২০০৮ সাল থেকে চলমান প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একই অবস্থান নিয়েছে নরওয়ে। চিলিতে আগামী ডিসেম্বরে আইএনপিই-এর সম্মেলন হতে যাচ্ছে, সেখানে নিশ্চয়ই ব্রাজিলকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আইএনপিই-এর গবেষণায় উঠে এসেছে জের বলসোনারো সরকার কৃষিবাণিজ্য আর খনি ব্যবসার মুনাফাখোর কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দিতে গিয়ে বনরক্ষাকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল রেখে কীভাবে দেশের বন-জঙ্গল উজাড় করছে।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের এই কয় মাসে প্রায় তিন হাজার বর্গ মাইল বেশি বন্য এলাকা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। সরকারের কৃষিমন্ত্রী নাকি স্বয়ং এই বাণিজ্যের লবিস্ট হিসেবে কাজ করেন। সে কারণে আমাজন-পোড়ার তথ্য বলসোনারো উড়িয়ে দিলেও ডিইটিইআর-বি স্যাটেলাইট সিস্টেম থেকে তোলা ছবিগুলোকে তিনি মিথ্যে বলবেন কী করে? আর এইসব ছবি থেকে উঠে এসেছে, ভেনিজুয়েলা বন পোড়ানোতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, যেখানে এই কয়েক মাসেই প্রায় সাড়ে ছাব্বিশ হাজার বন পুড়ে গেছে। তৃতীয় অবস্থানে আছে বলিভিয়া। ষোল হাজার বন পুড়ে ছাই হয়েছে এ দেশে। সব মিলিয়ে ‘আমাজনিয়া’র অবস্থা সত্যিই বেহাল। প্রে করা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
এভাবে পুড়তে থাকলে আমাজন ক্রমশঃ গাছের পাতা থেকে আর্দ্রতা হারাবে, এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যাবে আশংকাজনক হারে। অক্সিজেনের পরিমাণে টান পড়বে। ফলে পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশের ক্ষতি হবে। ক্রমশঃ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পৃথিবী আরো বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। মুনাফাখোরদোর হাতে অঢেল অর্থ জমা হচ্ছে, যা দিয়ে নিজেদের রক্ষায় অনেক কিছুই করতে পারবে তারা। কিন্তু আমাজনের জঙ্গলে এতকাল বেঁচে থাকা আদিবাসী মানুষ আর বিরল গাছপালা-পশুপাখিদের কী হবে? পরিবেশ বিপর্যয়ের আঘাত ঠেকাবে কীভাবে ব্রাজিলের দরিদ্র মানুষরা? এই আঘাত ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। উত্তপ্ত পৃথিবীর উত্তপ্ত দিনগুলো আমাকে, আমাদেরকেও কষ্ট দেবে। সেই কষ্ট সামলানোর উপায় কি আছে আমার, আমাদের?
মানুষের কষ্ট নিরসনের উপায় মানুষ জানে না, জানে তবে কে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/এমএস