রোহিঙ্গায় বসবাস
এবারও সফল হয়নি উদ্যোগ। কথা ছিল মিয়ানমারের ছাড়পত্র পাওয়া ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গা বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে ফেরত যাবে, কিন্তু তারা যায়নি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের দিন নির্ধারিত হয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো গেল না।
আমরা ঠিক এ ধারণাটাই করছিলাম যে, সেখানে নিরাপত্তার অজুহাত তুলে এরা ফেরত যেতে চাইবে না। এ কথাটি রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে কাজ করে এমন সাহায্যকারী সংস্থাগুলোও বলছিল। তবুও সরকারের দিক থেকে কেন আশাবাদ ছড়ানো হয়েছিল যে এরা যাবে সেটা বোধগম্য নয়। রোহিঙ্গারা যাবে, সেটা রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে নিশ্চিত না হয়ে এক তরফা ভাবে মিয়ানমারের পক্ষে থেকে হঠাৎ করে ঘোষণা দেয়া হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশ সেই ঘোষণায় পা দেয়।
রোহিঙ্গারা যাবে না, এটা তাদের এক শক্ত মনোজগত। আর ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফসহ যেসব আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে তাদের অনেকের কাছে শরণার্থী হল এক বাণিজ্যিক উপকরণ। যে শরণার্থী যেখানে ঢুকেছে, সেখানে তাদের স্থায়ী করে রাখাই ইউএনএইচসিআর ও অন্যান্যদের এখন পর্যন্ত সাফল্য।
দুই বছরের বেশি সময় আগে রোহিঙ্গারা যখন লাখে লাখে আসছিল তখনই বলেছিলাম এর নিকটবর্তী কোন সমাধান নেই। তাই মিয়ানমার অত্যাচার করে, জোর কর খেদিয়ে দিলেই আমাদের জায়গা দেয়াটা কতটা যৌক্তিক হবে সেটা ভাবা দরকার। সে সময় একথাও বলেছিলাম, রোহিঙ্গারাই হবে আজ এবং আগামীর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এদেশে যারা জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে তারা পারলে মিয়ানমারে গিয়ে যুদ্ধ করে এর প্রতিবাদে। তবে তাদের দৌড় যে অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করা পর্যন্তই সেটা বুঝা গেছে। তারা তখন চিৎকার করছিল যে সীমান্ত খুলে দিতে হবে এবং দেয়াও হয়েছে। শাসক দল এবং সরকারের ভেতরেও আন্তর্জাতিক পিঠ চাপড়ানিতে আবেগ তাড়িত হওয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
আসলে যেটি প্রথম কাজ ছিল তা হলো প্রথম দফা রোহিঙ্গা দলটি আসার পরপরই সীমান্তে কড়া পাহাড়া বসিয়ে পুশব্যাক করে মিয়ানমারকে কড়া বার্তা দেয়া দরকার ছিল যে তুমি এ কাজ করতে পারনা। তোমার দেশের নাগরিককে এদেশে আমরা জায়গা দিব না। কিন্তু উল্টো তথাকথিত মানবিকতা আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় বন্যার পানির মত ঢুকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ তখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন জনমতই তৈরি করতে পারেনি। শুধু একটা বাণীই দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে, ‘আমরা মহান’ এবং আমরা প্রয়োজনে ‘ভাগ করে খাদ্য খাব, তবুও রোহিঙ্গারা আসবে’। এখন আমরা বুঝতে পারছি এরা কত বড় বোঝা এবং সমস্যা আমাদের জন্য। এরা আমাদের প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, করে চলেছে এবং এরা আমাদের জন্য এক বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
অনেকেই তখন বলেছিলে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অত্যাচারে ভারতে আমরা এক কোটি নাগরিক আশ্রয় নিয়েছিলাম, তাই আজ বাংলাদেশ যেন সাহায্যের হাত বাড়ায়। কিন্তু দুটি বিষয়ে মৌলিক পার্থক্য আছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার যুদ্ধ করছিল এবং যুদ্ধে জয়ী হয়ে নাগরিকদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের মানুষের বড় অংশই উদার এবং প্রগতিশীল। অন্যদিকে এই রোহিঙ্গারা কোন দাবিই জোড়ালোভাবে তুলতে পারেনি এবং এরা অত্যন্ত অশিক্ষিত, গোড়া এবং সন্ত্রাসী প্রকৃতির।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা এক অতিকায় সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অবিলম্বে এই সংকটের সমাধান দেখছি না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর লাগাতার আক্রমণে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। চীন আর রাশিয়া সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে থেকেছে, ভারত মিয়ানমারকে হাতে রেখেছে, আমাদের প্রতিও কিছুটা মানবিকতা দেখিয়েছে। পশ্চিমা সম্প্রদায়ও অনেক ব্যাপারে ততটা শক্ত অবস্থান নেয়। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। আর ওআইসি বা ইসলামিক দেশগুলোর কাছে সেভাবে কোন প্রত্যাশাও ছিল না, তারা সেটা করেওনি।
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বলছেন রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে এবং সমাধান তাদেরই করতে হবে। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, বিশ্বকে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কূটনৈতিক ভাষা হিসেবে এ কথা সুন্দর কিন্তু এতে কোন কাজ হয় না। বাংলাদেশ শুরু থেকেই একটি পরিষ্কার ও দৃঢ় অবস্থান বিশ্বকে জানাতে পারেনি, পারেনি তার নিজ দেশের মানুষকেও জানাতে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া বা উদ্যোগ ‘রিএকটিভ’ ধরনের, ‘প্রোএকটিভ’ উদ্যোগ সেভাবে চোখে পড়েনি। আসলে এই দ্বিতীয় দফা উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশকে তার কৌশল বদলাতে হবে। অতি নরম, চাপে অতি নমনীয় ভাবটা ছেড়ে তার পুরো ভাবমূর্তিটা বদলে ফেলতে হবে। বিশ্বকে, মিয়ানমারকে জানান দিতে হবে এদের আর আমরা রাখতে পারছি না। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্প্রদায় সবাইকে নিয়ে মিয়ানমারকে একটা বড় চাপে ফেলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কিছুটা নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে এবং ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে। এটা ছিল জটিল এই সংকট নিরসনে কিছুটা অগ্রগতি। কিন্তু প্রতিকী একটা প্রত্যাবাসনও হল না।
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে সুবিধাভোগী একটা অংশ তৈরি হয়েছে। এরা এ সংকট থেকে নানাভাবে লাভবান হচ্ছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গিও এ সংকটের সমাধান চায় না। কারণ তাদেরও সুবিধার বিষয় রয়েছে। এসব নানা কারণে রোহিঙ্গা সংকট জটিল আকার ধারণ করছে।
কতগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনই শুরু না করার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা যেটা বলেছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে, সেটা অবশ্যই আদর্শিক অবস্থান থেকে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, শুধু তাত্ত্বিক ও আদর্শিক অবস্থানে থেকে বিশ্বের কোথাও সংকট নিরসন সম্ভব হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলো এই সংস্থাগুলোর কথাই শুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ যদি কঠোর না হয় এদের ফেরাতে, তবে এদেশের ভবিষ্যত সব সম্ভাবনা আঘাতপ্রাপ্ত হবে। কূটনীতিতে আরো সচল আর সক্রিয় হতে হবে। একমাত্র আন্তর্জাতিক চাপ-ই হবে মিয়ানমার ও তার সমর্থকদের ওপর কার্যকর পদক্ষেপ। সে চেষ্টাটাই করতে হবে আমাদের।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম