১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যবচ্ছেদ রেখা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে’ (পৃষ্ঠা ১৬৪)।
চরম ত্যাগের পরিণতি কি তবে ১৫ আগস্ট! আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত একটি দিন। ৭৫ এর এ দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চক্রান্তে তাদের এ দেশীয় অনুচরেরা হত্যা করে বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে। নিষ্ঠুরতম এ হত্যাকাণ্ডের কাছে পৃথিবীর বড় বড় ট্র্যাজেডিও ম্লান হয়ে যায়।
এ দেশের মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাতেন। বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য হিস্যা চাইতেন। এই ছিল তার অপরাধ! সে দাবি তিনি আদায়ও করে নিয়েছেন। বিনিময়ে তার প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে নির্মমভাবে।
জাতির জনককে হত্যা করার পরও খুনিচক্র নিরাপদ বোধ করেনি। এ বর্বর হত্যাকাণ্ডের অপরাধে দেশের প্রচলিত আইনে ভবিষ্যতে তাদের যাতে বিচার না হয় সে জন্য জারি করা হয় এক বর্বর অধ্যাদেশ, যা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। এভাবে আইন করে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিষিদ্ধ করা দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং গণতন্ত্র, ন্যায়নীতি, মানবাধিকার ও সংবিধান বা আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সবশেষে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে চার দশক পর জাতির জনকের হত্যার বিচার করেছে।
জনৈক খ্যাতিমান বিদেশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- ‘প্রায় ১২০০ বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পর বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় ও জাতিবিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তার সৃষ্টি এবং তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা।’
স্পষ্টতই, স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসেবেই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্য করা হয়েছে।
আজকে এটা প্রমাণিত যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল আসলে বাংলাদেশকে হত্যার জন্যই। বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলে একে একটি ব্যর্থ ও পঙ্গু রাষ্ট্র বানানোই ছিল ১৫ আগস্টের ঘাতকদের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ যেন বিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে লক্ষ্য অর্জনই ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য। ৭৫ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে আমরা এর সমর্থন পাই। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। বিজয় অর্জনের পর সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতো ৯ শতাংশ। এ হিসাব নিরূপণে বিভিন্ন যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছি যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ২০১১ সাল নাগাদ (তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ৯০ বছর) তিনি মোট ৭টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ সময়সহ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম ৩ বছর সময় পেতেন।’
মূলত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যবচ্ছেদ রেখা। এ রেখা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তিকে আলাদা করে রেখেছে। এ জন্যই বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট তার জন্মদিনের উৎসব করেন। এ উৎসব আসলে জন্মদিনের উৎসব নয়, খুনিদের প্রতি সমর্থনের ঘোষণা। অন্যদিকে জাতির শোকের দিনে জন্মদিন পালন করতে গিয়ে বেগম জিয়া কেবল বিতর্কিত নন, ঘৃণিত সবার চোখে।
ভুয়া জন্মদিন পালন থেকে শুরু করে ইতিহাস বিকৃতিতে কি না করেছেন তারা। কিন্তু জনগণের সত্যিকারের ভালোবাসা সেতো হৃদয়ে লেখা, সেখান থেকে তো আর মুচা যায় না? যায়নি, যাবেও না কখনও। হয়তো তারা সাময়িক লাভবান হয়েছে কিন্তু জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। দেশের জনগণই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ নির্মাণ করে চলেছেন। ‘তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রবন্ধে আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।’
লেখক : কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।
এনডিএস/পিআর