একাত্তরেও তাঁর চিন্তায় ছিল ক্রীড়াঙ্গন
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আধুনিকায়নে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম স্থপতি। কিন্তু তাঁর সেই স্থাপত্য শিল্প এখন করপোরেট জগতের হাতে বন্দী। যে কারণে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে কোটি কোটি টাকার কথা শোনা যায়। তারকা-মহাতারকাদের 'ব্র্যান্ড ভেল্যু'র ঝলকানি দেখা যায় টেলিভিশনের পর্দায়। তারকাদের 'ব্র্যান্ড ভেল্যু' এখন বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোও বিক্রি করতে চায়। সেদিক থেকে বলতে হবে, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন অনেক খানি এগিয়েছে!
কিন্তু শেখ কামালের ক্রীড়া দর্শনের সাথে আধুনিকায়ন মেলাতে গেলে, বানরের তেলমাখা বাঁশে চড়ে উপরে ওঠার অংকটাই মনে পড়ে যায়! শেখ কামালের ক্রীড়াচিন্তাকে সঙ্গী করে যদি খানিকটা এগিয়ে থাকে এদেশের খেলাধুলার জগত, তবে সাফল্য, আধুনিক অবকাঠামো এসবের বিবেচনায় পিছিয়েছে কয়েকগুণ! শেখ কামালের একাত্তরতম জন্মদিনে তার বন্ধু, সুহৃদরা এই কথাটা কোনভাবে মেনে নিতে পারবেন না। সেটা ভাল করেই জানি। তারপরও লিখতে হবে। কারণ, খোদ রবি ঠাকুর বলেছেন; ‘ইতিহাস হচ্ছে সত্য তথ্যের আধার।’
শেখ কামালকে বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সূচনা পর্ব লেখা সম্ভব নয়। তা আপনি শেখ কামালকে পছন্দ করুন বা নাই করুন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে তরুণ দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সেখানেও তাঁর মাথায় ছিল খেলাধুলা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে তাঁর বন্ধু-বান্ধবরাই ছিলেন। সেখানেও যখন দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল, ছুঁটে গিয়েছিলেন শেখ কামাল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের সেই দলটা নিয়েও রাজনীতি হয়। দল গঠনে কার কী ভূমিকা ছিল সেটা নিয়েও বির্তক। এত বছরেও আমরা বলতে পারি না, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল মানে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের ক্রীড়া সেক্টর! কারণ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদল হলে সেখানেও দলের থেকে ব্যক্তি বিশেষ বড় হয়ে যান!
স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেন আবাহনী ক্রীড়াচক্র। যে ক্লাবটার মধ্যে দিয়ে দেশজ ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম বইতে শুরু করে আধুনিকতার হাওয়া। শেখ কামাল ছিলেন তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের মত নিখাঁদ বাঙালি। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্লাবে আধুনিকতার ছোঁয়ার সাথে বাঙালিত্বের বুননটটাও ছিল। যে কারণে তিনি তাঁর ক্লাবের নামটা বেঁছে নেন; ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’।
কিন্তু জীবন থেকে দমকা হাওয়া যখন শেখ কামালকে আছড়ে ফেললো মৃত্যু উপত্যকায়, তখন থেকে ধীরে ধীরে তাঁর আবাহনীও রং পাল্টাতে শুরু করলো। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে আবাহনী ঢুকে গেলো করপোরেট জগতের পেটে। আবাহনী ‘ক্রীড়াচক্র’ হয়ে গেলো ‘লিমিটেড’! উন্নত বিশ্বে সব ক্লাবই লিমিটেড। বারসেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি সবাই লিমিটেড। কিন্তু তাঁদের গায়ে লিখতে হয় না লিমিটেড। কার্যক্রম বলে দেয়, তারা পেশাদার।
সেখানেও করপোরেট নিয়ম কানুন। কিন্তু শেখ কামালের আবাহনী আজ না ঘরকা, না ঘাটকা! পরিচালনা পর্ষদ আছে। কিন্তু নিয়মিত সেই পর্ষদের বৈঠক হয় কী না সেটা জানেন না অনেক পরিচালক! পরিচালকের সংখ্যা বেড়েছে। সেটাও খানিকটা রাজনৈতিক বিবেচনায়। যে কারণে, পরিচালক বাড়লেও আবাহনীর জৌলুস বাড়েনি। যে আবহানীর নামে এক সময় গোটা দেশ জুড়ে আওয়াজ উঠতো, তারুণ্যের ক্রীড়া ভালবাসার নাম হয়ে উঠেছিল যে ক্লাবটি,সেই ক্লাবের নাম এখন একটা প্রজন্মের কাছে অজানা! আবাহনীর চেয়ে তারা বেশি চেনে বার্সা, রিয়াল, চেলসি, ম্যানসিটি, লিভারপুল! তাহলে শেখ কামালের ক্রীড়া দর্শনে কতটা আধুনিক হলো তাঁর নিজের হাতে গড়া ক্লাব!
জীবনের স্কোরবোর্ডে মাত্র ২৬ রাখার পর যাকে রান আউট করা হলো, মৃত্যুর ওপার থেকে হোয়াটসআপ, ভাইবার, স্কাইপে যদি তিনি কথা বলতে পারতেন, তাহলে নিশ্চিত তিনি তাঁর বন্ধুদের বলতেন; ‘কীরে, আমি ২৬ এ ফিরলাম, কিন্তু তোরাতো ৭০ ছাড়িয়ে প্রত্যেকে, তাহলে আবাহনীর এই দীনতা কেন?’ হয়তো দুই একজন আমতা আমতা করে বলতেন;‘ আমরা চেষ্টা করেছি। তোর অনুপস্থিতিতেও আমরা ক্লাবটা ধরে রেখেছি। অনেক ট্রফিও জিতেছি। কিন্তু এখন তো আমরা কোণঠাসা!আবাহনীর কোনাই আমাদের আশ্রয়। সেটাও হয়তো কয়েকদিন পর থাকবে না!’
শেখ কামালের বন্ধুত্বের সৌজন্যে অনেকে অনেক কিছু হয়েছেন। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি শুধু তাঁর আবাহনীর। তারপরও শেখ কামালের মৃত্যুর পর আবাহনীর বৈরী সময়ে কিছু মানুষ খুব সাহসিকতার সাথে শেখ কামালের আবাহনীকে টিকিয়ে রেখেছিলেন, অর্থ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে, সমর্থন জুগিয়ে। তাঁরা অন্তত শেখ কামালের ক্রীড়া দর্শনে বিশ্বাস করতেন বলেই কাজটা করেছিলেন। কিন্তু শুধু বিশ্বাস, ভালবাসা দিয়ে এখনকার ক্রীড়াঙ্গনে তেমন কিছু করা যায় না। দরকার পড়ে আরো অনেক কিছু।
বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের স্থপতি দেখতে চেয়েছিলেন, এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আকাশমুখি এক অট্টালিকা হিসেবে। কিন্তু তাঁর নিজের ভালবাসার ক্লাবটা-ই আকাশমুখি হলো না। সেটা না সাফল্যে। না চেহারায়!
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমকেএইচ