বৃত্তের বাইরের জীবন

ডা. বিএম আতিকুজ্জামান
ডা. বিএম আতিকুজ্জামান ডা. বিএম আতিকুজ্জামান
প্রকাশিত: ১২:৪৪ পিএম, ০১ আগস্ট ২০১৯

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। সারাদিন বৃষ্টি হবে। কাজে এসেছি। এই কিছুদিন আগে ছুটি কাটিয়ে ফিরেছি। ছুটির আমেজ এখনো যায়নি। এরকম বৃষ্টিমুখর দিনে ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। পানির ধারে বসে জলপতনের ছন্দ শুনতে ইচ্ছে হয়।

অথচ আজ সবগুলো রোগী এসে হাজির। আমার প্রথম রোগী রুমে ঢুকতেই সে দাঁড়িয়ে পড়লো। দাঁড়াতে যেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। খারাপ আবহাওয়ার মাঝে অফিসে আসবার জন্য ধন্যবাদ জানালেন তিনি আমাকে। আমার মেঘলা দিন সাথে সাথে রোদেলা হয়ে গেলো।

রোগীর নাম উইলিয়াম। সবাই তাঁকে 'বিল' নাম ডাকে। বিল লিভারের কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে এসেছেন। বিল গল্পের মতো করে তাঁর রোগের ইতিহাস বলে যাচ্ছেন। বছর খানেক আগে বিল ছিলো নিউ ইয়র্কের একটি নামকরা সংস্থার বড়োকর্তা। দিন রাত পাগলের মতো কাজ করেছে। ক্ষমতা আর অর্থের বলয়ে খানিকটা বৃত্তবন্দী অবস্থাতে ঘুরছিলো তার জীবন।

তাঁর মা মারা যায় যখন সে হাই স্কুলে পড়ছে। বাবাই তাঁকে বুকে আগলে ধরে বড়ো করেছে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেষ করে ওয়াল স্ট্রিটের বড়ো চাকরিতে ঢুকবার পর পরই তার বাবা অরল্যান্ডোতে চলে আসলেন অবসর যাপনের জন্য। বছরে দুবার বিল তার বাবাকে দেখতে আসতো। এপ্রিলে তার বাবার জন্মদিনে আর নভেম্বরে থ্যাংক্সগিভিং এর ছুটিতে।

বছর খানেক আগে বিল খবর পেল বাবা প্রায় মরণাপন্ন। বাবাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে এলো সে। হাসপাতালে বাবার বিছানার পাশেই তাঁর তীব্র খিঁচুনি শুরু হলো। তাঁকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তার ব্রেনে টিউমার ধরা পড়লো। বিলেকে সাথে সাথে একই হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। বড়ো ধরনের একটি অস্ত্রোপচারের পর তার জীবন বদলে গেলো। বাবা মারা গেলো সে হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থাতে। অপারেশনের পর সে তার শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। কথা বলতে এখনো খানিকটা কষ্ট হয়। স্মৃতির চিলেকোঠা প্রায়ই গোলমেলে হয়ে যায় তাঁর।

atik

চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়েছে তাঁর। বন্ধুরা যে যার মতো ব্যস্ত। জীবন সঙ্গী করার মতোন সময় খুঁজে পায়নি সে। এখন একটি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসাকেন্দ্রে থাকতে হয় তাকে। সার্বক্ষণিক দেখা শোনার ভালো বন্দোবস্ত আছে। বিশাল অংকের টাকা আছে ব্যাংকে। সেসব খরচ হচ্ছে তাঁর চিকিৎসা সেবার জন্য।

বিল খুব দুঃখ করে বললো একটি বড়ো ছুটি নেবার ইচ্ছে ছিলো। আমাজনের জলপ্রপাতের ওপর পাখির মতো গ্লাইডিং করবার শখ ছিল তার। প্যাটাগোনিয়াতে হারিয়ে যাবার প্রচণ্ড ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছিলো বছরের পর বছর। বিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমাদের ভঙ্গুর জীবনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। বিলের সাথে আরো খানিকটা সময় কাটাবার ইচ্ছে ছিল। আরেকদিন হবে সেটি।

আমি জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকালাম। খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হলো। আজ কাজ শেষে ঘরে ফিরে বৃষ্টিতে নেমে পড়বো। আমার এসব পাগলামি আমার স্ত্রী সিলভীর সয়ে গেছে। এইতো সেদিন আইসল্যান্ডের গঅফস জলপ্রপাতের একটি নড়বড়ে পাথরের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম বলে সিলভী কি বকাই না দিয়েছিলো আমাকে। বললাম একটি ছবি তুলে দাও। স্মৃতি থাকুক।

আজ এ ছবিটির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে জীবনটা এসব পাগলামিতে ভরা থাকলে মন্দ হয় না। বিল যাবার আগে সে কথাটি বলে গিয়েছিলো আমাকে।

এইচআর/জেআইএম

আমি জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকালাম। খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হলো। আজ কাজ শেষে ঘরে ফিরে বৃষ্টিতে নেমে পড়বো। আমার এসব পাগলামি আমার স্ত্রী সিলভীর সয়ে গেছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।