দুর্বিপাকেও নীরব সুশীল: কীসের আলামত?

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ৩১ জুলাই ২০১৯

বন্যা, ডেঙ্গু ছাড়াও নানা সতর্কতা মাথায় নিয়ে কড়া নাড়ছে আরেকটি ঈদ। সরকার স্বীকার না করলেও প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আক্রান্ত বাংলাদেশ। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল বন্যায় ক্ষত-বিক্ষত। মিন্নি, প্রিয়া, গুজবসহ নানা দুর্নীতি ও ইস্যুর তোড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যার দুর্গতির খবর। এর বাইরে শঙ্কাজনক মাত্রায় চরম অবনতির দিকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ধর্ষণ, খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা নাগরিকদের উদ্বেগের পারদকে শুধু উপরেই তুলছে।

আগামী দিন কয়েকের মধ্যেই ঈদুল আজহা সামনে রেখে লাখ লাখ মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটবে বিভিন্ন গন্তব্যে। সারা দেশে জমে উঠবে পশুর হাট। বিপণিবিতানগুলোও জমজমাট থাকবে। শঙ্কা ও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এই সুযোগে আবার নামবে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, জাল টাকার কারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধীচক্র। সন্ত্রাসীরা নেমে পড়বে ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে।

পাড়া-মহল্লায়ও এখন গড়ে উঠেছে বিশেষ বিশেষ অপরাধীচক্র। প্রাতিষ্ঠানিক ধাঁচে তাদেরও রয়েছে চেইন অব কমান্ড। বিশার নেটওয়ার্ক। কিশোররাও জড়িয়ে যাচ্ছে এসব অপরাধচক্রে। তাদের হাতে হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বিদেশে অবস্থান করে সহযোগীদের মাধ্যমে দেশে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা দেশ-সমাজকে কোথায় নিয়ে যাবে বা যেতে পারে? ভেবে প্রশ্ন বা কূলকিনারা পাওয়া কঠিন।

লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, এ রকম অবস্থায়ও সুশীল-বুদ্ধিজীবী মহলের ভূমিকা রহস্যজনক। কেউ নীরব। কেউ ক্ষমতাসীন দলে একাকার। আর ভিন্নমত বা মাঝেমধ্যে হলেও টুকটাক কথা বলায় অভ্যস্তরা বেছে নিয়েছেন নির্লিপ্ততা। গোটা অবস্থাটা উদ্বেগের। রহস্যেরও। বুদ্ধিবান-যুক্তিবানদের এমন ভূমিকা ভালো বার্তা দেয় না।

ক্ষমতাঘেঁষা মহলটি সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানতাপস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্প্রতিক কয়েকটি মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, বুদ্ধিজীবীদের মানুষকে পথ দেখানোর কথা। কিন্তু তাঁরা চামচাগিরি করেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেন, দায়িত্ব পালন না করে উল্টোটা করেন, এটাই বাংলাদেশে হচ্ছে, চলছে। তিনি বলেন, ’আমরা উন্নতি অনেক করেছি, দৃশ্যমান উন্নতি আছে, অবকাঠামোগত উন্নতি আছে, জিডিপি পরিসংখ্যান আছে, বিদেশি প্রশংসা আছে। কিন্তু ভেতরের দুর্দশা হচ্ছে শিশুর। যে শিশু খেলতে চেয়েছিল, খেলতে গিয়ে ধর্ষিত হলো, খেলতে গিয়ে প্রাণ হারাল। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা। এই বাস্তবতাই প্রতিফলিত হচ্ছে, এই রাষ্ট্র নৃশংস, এই রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক।

উপলব্ধি কোন তলানিতে পৌঁছায় এতোগুলো মন্তব্য করলেন কম কথার মানুষ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী? কয়েক কথায় কতোগুলো বার্তা দিলেন তিনি? দুর্বৃত্ত-পেশিশক্তিবানরা তাদের কৌশল হিসেবে রাজনীতিকে বেছে নেয়। এ জন্য তারা ক্রমাগতভাবে রাজনীতিবিদদের প্রভাবিত করতে থাকে। অনেক সময় তারা রাজনীতিবিদদের ছায়া সহচরও হয়।

সুবিধাবাদীরাও মানুষের মধ্যে কাল্পনিক ধারণা তৈরির কৌশল নেয়। যার সুবাদে সুবিধা নিশ্চিৎ করে তারা। আধিপত্য বিস্তারও করে। এ ধরনের শক্তি এখন শহর, বন্দর, জনপদ সবখানে। অজগাঁয়েও। অপরাজনীতির এ সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে রাজনীতিকে মানুষের কল্যাণের জায়গা থেকে সরাতে ব্যাপক ভূমিকা তাদের।

এর পরিণতিতে প্রকৃত কর্মীরা রাজনীতিতে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সুশীল-বুদ্ধিজীবীরা কেন গুটিয়ে যাবেন? বন্যা, ডেঙ্গু, ধর্ষণ, খুন, গণপিটুনি, রাহাজানি, অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, অপহরণ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া থাকতে নেই কাদের? এমন নির্লিপ্ততার মাজেজা কোথায়? তাদেরকে কেউ বারণ করেছে অন্তত দু’চারটা কথা বলতেও? বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির এমন নির্লিপ্ততা একাত্তর, নব্বই বা ওয়ান ইলেভেনের সময়ও দেখা যায়নি। তা’হলে রহস্যটা কোথায়? তারা তো কম-বেশি সুবিধাজনক অবস্থায়ই আছেন। তাদের কথা বলার সুযোগ আছে।

নারী-শিশুদের ধর্ষণ, ধর্ষণের পর মেরে ফেলা, লোকজনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে বা গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা— এ রকম নানা ধরনের নিষ্ঠুর অপরাধের মাত্রা সামান্য বুঝজ্ঞানের মানুষকেও আহত করছে। কোন হিংস্রতা কোনটি থেকে কম, তা বলা কঠিন। ত্বকীকে যেভাবে টর্চার সেলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, বিশ্বজিৎকে যেভাবে সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণের পর পুড়িয়ে, গলাটিপে আরও নানা কায়দায় নির্যাতন করে যেভাবে একের পর এক খুন করা হচ্ছে, রেনুকে পিটিয়ে হত্যা— কোনটির নৃশংসতা কোনটি থেকে কম?

নির্যাতনের নতুন নতুন রাস্তা বের করা হচ্ছে। কর্মস্থলে নারী-পুরুষ-শিশু–কিশোরদের নির্যাতন করে হত্যার ধারাবাহিক খবরও আসছে। সব মিলিয়ে পুরো সমাজের এ অস্বস্তি ও অস্থিরতার নাড়া পড়ছে না বুদ্ধিজীবী মহল থেকে। এ নীরবতার ভাষা বোঝা কঠিন। না-কি কোনো কিছুর অপেক্ষার ইঙ্গিত বিদ্বৎসমাজের বৃহৎ অংশের আপস, সুবিধাবাদিতা, নীরবতা? জবাব যা-ই হোক স্বপ্ন-সুন্দরের আশা ছেড়ে তাদের প্রশ্নহীন, রোবট সোসাইটির সদস্য হয়ে যাওয়ার প্রবণতা সুখকর হতে পারে না।

নির্বিকারদের বিপরীতে আরেক অংশ যখন ঢালাওভাবে মন্তব্য করে সেটাও সমাজের জন্য একরকম অশনি সংকেত। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুলিশ বিভাগ চিরকালই প্রশ্নবিদ্ধ একটা প্রতিষ্ঠান। বাঘে ছুঁলে এক ঘা, পুলিশ ছুলে আঠারো ঘা' সহ নানা উপমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। কিন্তু তাই বলে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান সব 'নির্বাসনে গেছে' ধরনের মন্তব্য অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছু নয়।

মুরুব্বির আসনে বসে যারা বদলানোর ডাক দেবেন, তারা কতোটুকু বদলেছেন? দেশকে বদলাতে হলে আগে ব্যক্তির বদলানোর বিষয় রয়েছে। কিন্তু, কজন পেরেছেন বদলানোর দুয়েকটা উদাহরণ তৈরি করতে? রাষ্ট্র বদলানোর আগে, রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো বদলানোর প্রশ্ন রয়েছে। তারও আগে থেকে যাচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ পরিবর্তনের বিষয়। এর পরই না দেশ- সমাজ বদলের আশা। পরিবর্তনের প্রথম শর্ত হচ্ছে শিরদাঁড়া শক্ত করে, বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে প্রশ্ন করা। ফয়সালায় আগুয়ান হওয়া। সেই প্রশ্নে আমাদের ভরসা সুশীল-বুদ্ধিজীবী মহল। কিন্তু, সেখানেও নিরাশা-দুরাশার অন্ধকার।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

মুরুব্বির আসনে বসে যারা বদলানোর ডাক দেবেন, তারা কতোটুকু বদলেছেন? দেশকে বদলাতে হলে আগে ব্যক্তির বদলানোর বিষয় রয়েছে। কিন্তু, কজন পেরেছেন বদলানোর দুয়েকটা উদাহরণ তৈরি করতে? রাষ্ট্র বদলানোর আগে, রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো বদলানোর প্রশ্ন রয়েছে। তারও আগে থেকে যাচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ পরিবর্তনের বিষয়। এর পরই না দেশ- সমাজ বদলের আশা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।