স্থিতিশীলতা ধ্বংসের চক্রান্ত?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০১:১৩ পিএম, ২৭ জুলাই ২০১৯

প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যা, লাগাতার ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনার পর এখন সময় ছেলে ধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি। অনেকেই বলছেন এগুলো হচ্ছে, কারণ সমাজে মূল্যবোধের পতন ঘটছে, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা বাড়ছে। কিন্তু এসব মন্তব্য কতটা যৌক্তিক? গণপিটুনিতে পকেটমার, চোর ও ডাকাত সন্দেহে হত্যা বহুকাল ধরেই প্রচিলিত। এমনকি ছেলেধরার গুজবও নতুন নয় এবং ছেলেধরা সন্দেহে মানুষকে সম্মিলিতভাবে হত্যা করাও নতুন নয়।

তাহলে প্রশ্ন আসে নতুনত্ব কোথায়? নতুন হল রটনার ধরন। পদ্মাসেতুতে মানুষের কল্লা বা মাথা লাগবে, এমন এক গুজবের প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ঘটেছে। পদ্মাসেতু কেন্দ্রিক এই গুজবটি ছড়ানো হয়েছে পরিকল্পটিতভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। স্পষ্ট দেখা গেছে সরকার বিরোধী ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চক্র ফেসবুক ও ইউটিউবে এসব ছড়িয়েছে। এই রাজনীতিটা হল হিস্রতার রাজনীতি, যে রাজনীতির নানা প্রকার রূপ আমরা আগেও দেখেছি।

আত্মস্বার্থরক্ষায় এদেশের মানুষ বরাবরই অসহিষ্ণু। আধিপত্য কায়েমের জন্য অন্য মত অন্য পরিচয়ের প্রতি আস্থা না রাখাই আমাদের সংস্কৃতি। হিংস্রতায় এখানকার মানুষ এতটাই নেশগ্রস্ত যে, খোদ রাজধানীতে স্কুলের সামনে একজন নারীকে প্রচণ্ড আক্রোশে দিনে দুপুরে সম্মিলিতভাবে হত্যা করা যায়। কেন এত হিংসা? কেন এত উন্মত্ততা? আসলে আমাদের রাজনীতিটাই এমন। সহিংসতাকেই রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছে দেশের দলগুলো।

বাড্ডায় রেনু হত্যার যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে যে প্রধান ভূমিকা রেখেছে হিংস্রতা প্রদর্শনের সে অতি অল্প বয়সের একটি ছেলে। কেন এমন হিংস্রতা এই প্রশ্নের চেয়ে জরুরি এর ফলাফল কী সমাজে সেটা জানা। একটু দেরীতে হলেও পুলিশ মাঠে নেমেছে, হত্যাকারীদের, গুজব রটনাকারীদের ধরতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের তরফে একটি কঠোর বার্তা দেয়া প্রয়োজন সহিংসতার পথে যারা চলতে চায় তাদের।

পুলিশী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত এটি থামবে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, সামাজিক অস্থিরতা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা দিতে পারে। যে রাজনৈতিক শক্তি অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে চায় তাদের একটা উদ্দেশ্য আছে। তারা অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে চায়। তারা জানেন এর ফলে পুরোনো বিনিয়োগকারীরা অস্থির হবেন, নতুন বিনিয়োগকারীরা সংশয়ে পড়তে পারেন।

বাজেট পেশের পর একটি মাসও ঠিকমত যায়নি। নতুন অর্থ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে মাত্র। এমন অবস্থায় এমন অস্থিরতা, তাও দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্ধাসেতুকে ঘিরে গুজব ছড়িয়ে এসব হত্যাযজ্ঞ ঘটানো, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মানসিক অস্থিরতায় ফেলার একটা কৌশল কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।

সুখবর ছড়িয়ে পড়তে বেশ সময় লাগে আমাদের দেশে। কিন্তু গুজব বা মিথ্যা রটনা হু হু করে ছড়ায় দাবানলের বেগে। এখনকার এই ছেলেধরা গুজব ও গণপিটুনির ঘটনা হল মিথ্যার জেরে তৈরি হওয়া এক সামাজিক অস্থিরতা। এই মিথ্যা আচমকা এমনি এমনিই রটতে শুরু করল, এমন কিন্তু নয়। আগেই বলেছি এই মিথ্যা রটানো হয়েছে এবং পরিকল্পনামাফিক পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তোলা হয়েছে। সেই ফাঁদে পা দিয়েছে সাধারণ মানুষের একটি অংশ।

মাথা কিভাবে ধোলাই করা হয়েছে ভাবলে অবাক হতে হয়। কেউ দেখেনি, কিন্তু বলা হচ্ছে, মাথা কেটে নিচ্ছে, দা আর ছুরি নিয়ে ঘুরছে একটি চক্র। সামাজিক মাধ্যমে আজগুবি সব ছবিও ঘুরছে। বলাই বাহুল্য এই রটনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

কারা রটাচ্ছে এই মিথ্যা? যারা অস্থিরতা চায়, তারাই যে রটাচ্ছে এই মিথ্যা, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, সামাজিক পরিসরে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বহাল থাকলে দুষ্কৃতীদের সমস্যা হয়। সমাজকে অশান্ত-চঞ্চল করে তুলতে পারলে, স্থিতিশীলতা ভেঙে দিতে পারলে নানা দুষ্কর্মের সুবিধা হয়। স্থিতিশীলতা নষ্ট করার লক্ষ্যেই যে এই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দিগ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

সামাজিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে অনেক বড়সড় কোনও অঘটন ঘটাতে চায় হয়তো একটা শক্তি। কোন বহিঃশক্তির যোগসাজশে এই অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে না, সেটাও নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছেনা। এই অস্থিরতার মাঝেই গত সপ্তাহে ঢাকার দুটি স্থানে পুলিশের দুটি চেক পয়েন্টের সামনে বোমা পুঁতে রাখার ঘটনার ঘটেছে এবং এর দায় স্বীকার করেছে কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ইসলামিক স্টেট গ্রুপের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স একটি টুইট বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকেও আইএস সম্পৃক্ততার তথ্যটি নিশ্চিত করা হয়নি।

দেশকে অশান্ত করে তোলার বা এ দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চলছে। সে অপচেষ্টা যারা চালায়, তারা যে দেশের ঘোর দুষমন। পেট্রল বোমা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো এখনো দগদগে হয়ে রয়েছে। তাই নতুন করে অস্থিরতা বা সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে দেয়া যাবে না।

পুলিশের পক্ষ থেকে অ্যাকশনে যেতে সামান্য বিলম্বের কারণে ভিত্তিহীন গুজবটা হু হু করে ছড়াতে পেরেছে। বেশ কয়েকটা গণপিটুনি এবং গণপ্রহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অবিলম্বে আমাদের প্রত্যেককে সতর্ক হতে হবে। সামাজিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার চক্রান্তকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখতে হবে। সরকারের অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা মানুষ করবেই, কিন্তু সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে স্থিতিশীলতাকেই ভেঙে দিতে চায় যারা তারা দেশের শত্রু।

এইচআর/জেআইএম

মাথা কিভাবে ধোলাই করা হয়েছে ভাবলে অবাক হতে হয়। কেউ দেখেনি, কিন্তু বলা হচ্ছে, মাথা কেটে নিচ্ছে, দা আর ছুরি নিয়ে ঘুরছে একটি চক্র। সামাজিক মাধ্যমে আজগুবি সব ছবিও ঘুরছে। বলাই বাহুল্য এই রটনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন