গুজব কিন্তু আজব নয়
গত মে মাসে গিয়েছিলাম খুলনার ডুমুরিয়ার এক দূর গ্রামে। আর এই মধ্য জুলাইয়ের পরে গেলাম রোহিঙ্গা শিবিরে। সবখানেই ছেলে ধরা গুজব শুনছিলাম। মে আর জুলাইয়ের মধ্যে ঢকায়ও গুজবের ঢেউ একটু আধটু কানে লাগছিল না তা নয়। কিন্তু সেই ঢেউ যে সুনামির মত হয়ে আসবে তা ভাবিনি।
ঢাকা এবং এর আশপাশসহ সারাদেশে এক দিনে যখন ছেলেধরা সন্দেহের গণপিটুনিতে পাঁচ জন মারা গেলো এবং সাত জন আহত হলো তখন সবাই নড়েচড়ে বসলো। এর পরই নানা জায়গা থেকে গণপিটুনিতে আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। দিন ১৫ আগে পটুয়াখালীতে এক বৃদ্ধকেও একই সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তখন কিন্তু গণমাধ্যমেও খবরটি সেরকম জায়গা পায়নি।
কোন সন্দেহ নেই, দেশের প্রতিটি অলিগলিতে এখন এই গুজবের প্রতিক্রিয়া অনেকের কাছে আসন্ন বিপদের আশঙ্কা। আলাদা করে বলার কিছু নেই। প্রতিটি সুস্থ সবল নিরপরাধ মানুষকে মুহূর্তেই হত্যা, বা জখম করা নৃশংশতার চূড়ান্ত। নিহত এবং আহতদের মধ্যে ক’জন প্রতিবন্ধীও আছেন। এটা কোন ধরনের অসভ্যতা তা ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার কাছে নেই। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, এতে আমাদের সভ্যতার সূচক আরেক দফা নেমে গেছে।
আমি আসলে বলার চেষ্টা করছি এবারের গুজবটা কিন্তু নতুন নয়। চাইলেই এর ভয়ঙ্কর প্রভাব এড়ানো যেতো। কারণ আমরা সবাই নিশ্চয়ই এই আলোচিত “ছেলেধরা’র ছেলে ভুলানো ধারণাটি মনে করতে পারি। মায়েরা শিশুদের ঘুমপাড়ানোর সময় ছেলেধরার কথা বলে ভয় দেখাতেন। মায়ের কাছে এই ভয় দেখেননি, এমন বাঙালির সংখ্যা কম। কিন্তু সেই ছেলেধরার অস্তিত্ব সব সময় গল্পেই ছিল। শিশু চুরি বা পাচারের সত্যতা কখনো কখনো পাওয়া গেলেও তা নিয়ে এমন মহামারী আকারের গুজব কখনো হয়নি।
তবে আমাদের যখন যেখানে সেতু নির্মাণ হয়েছে তখন সেখানে এই ছেলেধরার গুজবের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বলা হয় সেতুর পিলারে ছোট বাচ্চার মাথা না দিলে সেতু শক্ত হয় না। এজন্যে সেতু কর্তৃপক্ষের লোকজন শিশু চুরি করায়! কী অদ্ভুদ….! এই লেখাটি যখন লিখছি তার একদিন আগেই একদল অল্প বয়সী তরুণ চাঁদে গেলো। তাই সুকুমার রায় ছাড়া এই “অদ্ভুদ” ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে, এমন কারো নাম মনে করতে পারছি না।
জাতি হিসেবে আমরা যে অনেক আগে থেকেই গুজববান্ধব, এর বহু প্রমাণ আছে। সারাদেশে যুক্তিবাদি মানুষ থাকলেও গুজব বিশ্বাসীরা সংখ্যাগুরু। যুক্তিবাদিরা গুজববাজের সংখ্যা কমাতে পারেননি। তাই খারাপ লাগলেও জাতির “গুজববান্ধব” পদবী সবাইকে মানতে হবে। এই সপ্তাহ খানেকে আগেও ঝিনাইদহের একটা টিউব ওয়েলের গল্প এসেছিল গণমাধ্যমে। একটি টিউবওয়েল বসানোর পর গুজব ছড়ালো এর পানি খেয়ে “সব রোগ সেরে যাচ্ছে।” আর যায় কোথা ? নানা এলাকা থেকে লোকজন আসা শুরু হলো, হাড়ি বালতি বোতল নিয়ে। পানি বিক্রিও চললো।
গণমাধ্যমে খবর প্রচারের পর টিউবওয়েলটি উঠিয়ে নিল স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু পর দিন সেখানে গিয়ে দেখা গেলো কিছু মানুষ পানির জন্যে বিলাপ করছে। পানি না পেয়ে গায়ে কাদা মাখছে। ক্ষুব্ধ লোকজন সাংবাদিকদের বলছে টিউবওয়েল না ফিরিয়ে দিলে তারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবে। দরকার হলে জীবন দেবে। সাংবাদিকরা আরো খোঁজ নিয়ে দেখলেন এই কুদরতি টিউবওয়েলের মার্কেটিং করছেন খোদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আমার ভয়টা ঠিক এখানেই। আমি যতদূর জানি পদ্মাসেতুকে ঘিরে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়েছে অন্তত ছয় মাস আগে। কিন্তু এই গুজববান্ধব জাতির রক্ষক হিসেবে যাদের ভয় পাওয়ার কথা ছিল তারা কিন্তু সময়মত বিষয়টা পাত্তা দেননি।
কুদরতি পানি ,গাছের শিকড়, গ্রাম্য কবিরাজি নিয়ে এমন উন্মাদনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের সারাদেশে। সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে গুজবের গোড়ায় এরকম চেয়ারম্যান টাইপ কেউ আছেন। যিনি জানেন একটা গুজব ভালমত ছড়াতে পারলেই কেল্লাফতে। মূল ব্যবসা তো চলবেই পাশাপাশি গড়ে উঠবে নানা পাশ ব্যবসা।
গণমাধ্যম, বড় ডাক্তার, প্রশাসন কেউ চাইলে গুজবের অবকাঠামো সরাতে পারেন না। দরকার হলে দলবেঁধে গুজবের পক্ষে রাস্তায় নামে মানুষ। কারণ প্রতিটি গুজব অর্থনৈতিক। তাই মাঠের নির্বোধ মানুষকে অল্প কিছু টাকা দিয়ে দানবীয় করে তোলার জন্যে খুব কঠিন হয় না। অন্তত অতীত অভিতাজ্ঞতাগুলো তাই বলে। গুজব বিশ্বাসীদের কত ভয়ঙ্কর করে তোলা যেতে পারে, তা স্মরণ করতে আমি বগুড়ায় চাঁদে সাঈদীকে দেখার ঘটনা মনে করতে বলবো।
মোদ্দা কথা, গুজবের এই অপসংস্কৃতি চর্চা এবং এর ফলাফল আমাদের কাছে নতুন নয়। তাহলে এত দিন এই ছেলেধরা গুজব কেন মাঠে আছে সেটাই তো আমার কাছে অবাক লাগছে। পরিস্থিতি তো আরো ভয়াবহ হচ্ছে। ছেলেধরা গুজবের আরো নানামুখি অপব্যবহার বের হচ্ছে। এখানে লিখে সেগুলোর প্রচার বাড়াতে চাই না। কিন্তু যাদের এগুলো ঠেকানোর কথা তারা বিষয়টি জানে আমি নিশ্চিত। কিন্তু সেতু কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের সাবধান বাণী ছাড়া আমি এই গুজব ঠেকানোর কোন পদক্ষেপ এখনো দেখছি না।
অতীতের আলোচিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গুজবটা ছড়ায় সত্যিকার অর্থে অশিক্ষিত, আধা শিক্ষিত মানুষের মধ্যে। আর এরাই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এদের মধ্যে সচেতনতা দরকার। ঘরে ঘরে কানে কানে প্রচার দরকার। শক্ত করে বলতে হবে সেতু বানাতে লোহা সিমেন্ট বালি আর কংক্রিট ছাড়া কিছুর দরকার নেই। সব জীবিত মানুষ একটু একটু করে এসব উপাদান একত্র করে একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে। মৃত মানুষ সেতুর কোন কাজেই আসে না। সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলো এই প্রচারে শক্ত ভূমিকা রাখতে পারে। এগিয়ে আসতে পারেন সচেতন ফেসবুকবাসীও।
অনেকেই হয়তো বলতে চাইবেন এই গুজব কারা ছড়িয়েছে কেন ছড়িয়েছে সেটা খুঁজে বের করা দরকার। এ বক্তব্য মূল্যহীন নয়। গুজব ঝড় থেমে গেলে না হয় করা যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সমাজের একটি বিশাল শ্রেণির মানুষের জন্যে এটা খুব দরকারি নয়। এরা রয়েছে একেবারে খাদের কিনারায়। যে কোন মুহূর্তে যে কেউ রেনু বেগম অথবা সিরাজ বনে যাবেন। ছেলেধরা সন্দেহে কারো ওপর হামলা করবেন এদেরই আরেকটি অংশ। কারণ ফাঁকা মাথার এই শ্রেণিই চোখের সামেনে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করতে দেখে। আবার এরাই একজন প্রতিবন্ধীকে পিটিয়ে হত্যা করে। এদের বাঁচানো তো সবার আগের কাজ। কী আর করা। আমরা আমরাই তো।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম