চিলের পেছনে না দৌড়ে কানে হাত দিন

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ২২ জুলাই ২০১৯

‘পদ্মা সেতুতে এক লাখ মাথা লাগবে’, এই গুজবটি আমিও দেখেছি, শুনেছি। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আমি এক লাইনও লিখিনি। আমি ভেবেছি, আমি লিখলে, এই অসম্ভব গুজবটি আরেকটু ছড়ানো হবে। কিন্তু ঠেকাতেও পারিনি। দাবানলের মত সেই গুজব ছড়িয়ে গেছে দেশজুড়ে। এই গুজবের হাত ধরে এসেছে আতঙ্ক, ভয়াবহ আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক এরই মধ্যে কেড়ে নিয়েছে বেশ কয়েকজনের প্রাণ। গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন
বেশ কয়েকজন।

পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প। কিন্তু শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশী অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু অনেককে ভুল প্রমাণ করে পদ্মা সেতু এখন আর শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। মাওয়া বা জাজিরায় গেলে যে কেউ দেখতে পাবেন, পদ্মার দুই প্রান্তকে দ্রুত জুড়ে দিচ্ছে সেতু। আমার ধারণা কোনোভাবেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ ঠেকাতে না পেরে একটি মহল সুকৌশলে মানুষের সাথা লাগার গুজব ছড়িয়েছে।

যাদের ভালো লাগে না, তাদের আসলে কিছুই ভালো লাগে না। সো গল্পের মত। তাদের কোনো ছেলে হবে না। ছেলে হওয়ার পর, এই ছেলের পড়াশোনা হবে না। পড়াশোনা হওয়ার পর বললো, চাকরি পাবে না। চাকরি পাওয়ার পর বললো, বেতন পাবে না। বেতন পাওয়ার পর বললো, এই টাকা চলবে না। তেমন অবস্থা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও। ঠেকানোর আর কোনো উপায় না পেয়ে, গুজব ছড়িয়ে দিল। যতটা বিতর্কিত করা যায়, ততটাই যেন কারো কারো লাভ।

একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল বাংলাদেশেও মানুষ ‘সেতুতে মানুষের মাথা লাগার’ গুজবে বিশ্বাস করে এটাই অবিশ্বাস্য। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য। সারাদেশে এখন ছেলেধরা আতঙ্ক। এই আতঙ্কের আগুনে ঘি ঢেলেছে আসলে নেত্রকোনার এক মাদকাসক্ত। সে তার এক প্রতিবেশী শিশুর কাটা মুন্ডু নিয়ে মেথর পট্টিতে গিয়েছিল মদ কিনতে।

সেখানে তার ব্যাগ থেকে ফোটা ফোটা রক্ত পড়তে দেখে লোকজন জিজ্ঞাসা করলে সে দৌড় দেয়। তখন লোকজন ধাওয়া করে তাকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে। একজন মানুষ একটি ব্যাগে করে শিশুর কাটা মুন্ডু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা অবশ্যই আতঙ্কের। আমাদের ‘বুদ্ধিমান’ মানুষেরা দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেললেন, এই লোক নিশ্চয়ই শিশুর মাথা নিয়ে পদ্মা সেতুতে যাচ্ছিল।

আসলেই এই মাদকাসক্ত উন্মাদ কেন শিশুটিকে খুন করেছে, সেটা তার কাছ থেকেই জানা সম্ভব ছিল। কিন্তু সম্ভাবনাকে মুহূর্তেই হত্যা করেছে সেই এলাকার মানুষগুলো। গণপিটুনিতে হত্যা মানে কিন্তু স্রেফ খুন, সম্মিলিত খুন। এটা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন। বিচার ছাড়াই কাউকে খুন করে ফেলছেন। ক্রসফায়ার যেমন খুন, গণপিটুনিও খুন। দুটিই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একটি পুলিশ করছে, আরেকটি আপনি করছেন। যেই করুক, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই নির্মম, নিষ্ঠুর।

কিন্তু গত শনিবার সকালে ঢাকার উত্তর বাড্ডার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শিশুচোর সন্দেহে তসলিমা বেগম রেনুর মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। চার বছর আগেই স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় রেনুর। দুই সন্তান নিয়ে তিনি একাই থাকতেন। সেদিন তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন, ছোট সন্তানের ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে। এমন একজন নিরপরাধ মানুষকে আমরা পিটিয়ে মেরে ফেললাম! আমরা কি তার অপরাধ যাচাই করেছি। গ্রামে-গঞ্জে নয়, খোদ রাজধানীর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে টেনে নিয়ে একজন অভিভাবককে মেরে ফেলবো পিটিয়ে! আমরা কি আদৌ মানুষ? নাকি আতঙ্ক আমাদের অন্ধ করে দিয়েছে, আমাদের বিবেক-মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে।

আহারে একাকী মায়ের সংগ্রাম এমনভাবে থেমে গেল। আমি খালি ভাবছি, সেই সন্তান দুটির এখন কী হবে? আপনারা যারা রেনুকে হত্যা করেছেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, তার শিশু দুটির কথা। একটা এলাকার এক-দুজন মানুষ ক্রোধে অন্ধ হতে পারেন। কিন্তু কয়েকশ মানুষ কীভাবে অমানুষ হয়ে যায়। পুলিশ ৪/৫ শ অজ্ঞাতনামা লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আমি চাই খুঁজে খুঁজে এই খুনিদের বের করা হোক। তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। গণপিটুনির নামে কোনোভাবেই এই খুন মেনে নেয়া যায় না। দেশের আর কোথাও যেন আর একটিও গণপিটুনির ঘটনা না ঘটে।

আপনি যদি এই যুগেও গুজব বিশ্বাস করেন, সেটা আপনার সমস্যা। আতঙ্ক থাকলে আপনার সন্তানকে চোখে চোখে রাখুন। কাউকে সন্দেহ হলে, তার সাথে কথা বলুন। কেন এসেছে, কী চায় জানুন। অপরাধী মনে হলে পুলিশকে ডাকুন। কিন্তু কোনোভাবেই আইন হাতে তুলে নেবেন না। বেশি সমস্যা হলে, আপনার সন্তানকে ঘরে আটকে রাখুন। কিন্তু নিরপরাধ মানুষের জীবন নেয়ার কোনো অধিকার আপনার নেই।

আপনার সামনে মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলে, আপনি নির্বিকার। কিন্তু নিরীহ মানুষ পেলে সবাই মিলে বীরত্ব দেখাবেন, এটা চলতে পারে না। গণপিটুনিতে অংশ নেয়া প্রতিটি মানুষের বিচার চাই আমি। এই যে ক্রসফায়ারে আমরা উল্লসিত হই। পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলি। এটা কিন্তু আমাদের ভয়ঙ্কর মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ। আমরা কি তবে জাতিগতভাবেই নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি? তবে বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতাই এই অবস্থার জন্য দায়ী। মানুষ এখন মনে করে, পুলিশে দিলে বিচার হবে না। তাই তারা বিচার ছাড়াই মেরে ফেলছে। এই ভয়ঙ্কর মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।

শুরু করেছিলাম গুজবের কথা দিয়ে। শেষও করছি, গুজবের কথা দিয়েই। চিলে কান নিয়ে গেছে, এটা শুনেই চিলের পেছনে দৌড় দেবেন না। আগে নিজের কানে হাত দিয়ে দেখুন। ‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’ এই গুজবটি বিশ্বাস করার আগে, আপনি আপনার শিক্ষা দিয়ে, বিবেচনা দিয়ে চিন্তা করুন। এই সময়ে এমন একটি কথা আপনি বিশ্বাস করছেন, আপনার একটুও লজ্জা লাগছে না। আপনার হাতে স্মার্ট ফোন আছে, চাইলেই পৃথিবীর সব তথ্য আপনি পেতে পারেন। একটু খুঁজে দেখুন। অন্ধের মত কিছু করবেন না। অন্তত আইন হাতে তুলে নেবেন না, মানুষের গায়ে হাতে তুলবেন না।

প্লিজ আপনারা নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, নিজের জ্ঞান দিয়ে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিন।

Provas-Amin-1

এইচআর/পিআর

চিলে কান নিয়ে গেছে, এটা শুনেই চিলের পেছনে দৌড় দেবেন না। আগে নিজের কানে হাত দিয়ে দেখুন। ‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’ এই গুজবটি বিশ্বাস করার আগে, আপনি আপনার শিক্ষা দিয়ে, বিবেচনা দিয়ে চিন্তা করুন। এই সময়ে এমন একটি কথা আপনি বিশ্বাস করছেন, আপনার একটুও লজ্জা লাগছে না

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন