পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
একটি সমাজকে দেখা ও জানা যায় অনেকভাবে। যার যেমন চশমা, সে তেমন দেখে। এবার আমরা অন্যরকম একটি ধারণা নেবো। পত্রিকার শ্রেণিবদ্ধ পাতায় ‘পাত্র-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের পাতা থেকে। এখানে অসামান্য কিন্তু নিদারুণ এক চিত্র দেখা যায়। ধারণা পাওয়া যায় একটি সমাজ সম্পর্কে, বিয়ের বাজারে কোন ধরনের ছেলেমেয়ের চাহিদা কেমন। এ চাহিদার পরিবর্তনও হয়- আগে পাত্রীর ক্ষেত্রে দেখা হতো মেয়ের বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা, এখন দেখা হয় মেয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা।
সাথে যোগ্য পাত্রী হতে হলে ফর্দটা হয় বেশ লম্বাই। পাত্রী চিকিৎসক, প্রকৌশলী যা-ই হোন না কেন, প্রথমত ‘সুন্দরী’ হতে হবে এ ধারণার খুব একটি বদল ঘটেনি। এরপর লম্বা চুল, ফর্সা ত্বক, উচ্চতা, বয়স, মেধা, শিল্পপতির মেয়ে ইত্যাদি চাওয়া হচ্ছে পাত্র পক্ষ থেকে।
দিন দিন দেশ অনেক এগিয়েছে। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। তবু বিয়ের সম্পর্কে নারী সেই পণ্যই রয়ে গেছে। এই পণ্যের দাম নির্ভর করে অন্য পণ্যের সঙ্গে তুলনায় সে কত সুন্দরী, সেই হিসেবে।
বাংলাদেশ, ভারত এবং এর আশপাশের দেশগুলোতে এখনো ঘটা করে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখার রেওয়াজ বিদ্যমান। প্রাগৈতিহাসিক এমন পাত্রী দেখার হার হয়তো কমেছে। কিন্তু অনেক শিক্ষিত-যোগ্য বিয়ের এমন বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় এখনো উভয়কে।
খ.
একটু পরিষ্কার করে বললে এমন- বিবাহের মাধ্যমে পরিবারের সূত্রপাত হয়। এছাড়া বিবাহের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। স্বামী ও স্ত্রীর যৌথ জীবনকে ‘দাম্পত্য জীবন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। একইভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। বিবাহ মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনি প্রথাও বটে। বিবাহবহির্ভূত যৌনসঙ্গম অবৈধ বলে স্বীকৃত এবং ব্যভিচার হিসেবে অভিহিত একটি পাপ ও অপরাধ। এটির সুন্দর ও সুস্থ মেসেজ নিয়ে অনেক সংস্থা বা পোর্টাল কাজ করে। আগ্রহীরা ‘পাত্র-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দেয়। যেমন আসে ‘মেয়ের জন্য পাত্র চাই’। মেয়ের যোগ্যতা যেমনই হোক ছেলেকে ‘সেরা’ হওয়া চাই। কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া পাত্রী লিখেছেন, ‘আমি খুব সুন্দরী নই, তবে দেখতে খারাপ নই।’ আরেক পাত্রী ‘প্রতিষ্ঠিত, সুন্দর, গ্র্যাজুয়েট, ভালো পরিবার, ভালো জব...’ এসব গুণের পাত্র চেয়েছেন। আরেকজন ‘ফ্রেশ মাইন্ডের স্মার্ট’ পাত্র চেয়েছেন।
এহেন ভণ্ডামির বিজ্ঞাপন দেখে ধৈর্য রাখা মুশকিল হয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এদের বৈবাহিক অসন্তোষ লেগেই আছে। বিয়েই থাকে হরেক রকমের রঙিন পোশাকি আয়োজন, কিন্তু সংসারে থাকে না রঙিন ভাবনার জীবনবোধ। মাঝে মধ্যে আধুনিক কালেও যোগ্যতার বহর শুনে বোবা হয়ে বসে থাকি। ধর্ম বোঝে না, পালন করে না, কিন্তু পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে ধর্মীয় নিষ্ঠার পরিচয় মেলে। অথচ কেউ দেখে না মানসিকতা, মানবিকতা, সহমর্মিতা। একমাত্র সুন্দর মন ও জীবন সুখকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে।
অন্যদিকে কয়েক বছর আগে দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ছাপা হওয়া বিয়ের বিজ্ঞাপনের ওপর এক গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরি গায়েন দেখেছেন, সমাজে কালো মেয়েরা কী ভয়ানকভাবে অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে! বিয়ের জন্য ফর্সা মেয়েই পরম আকাঙ্ক্ষিত। বিষয়টির আরও গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি জেনেছেন, ফর্সা না হওয়ায় শহরে-গ্রামে অসংখ্য নারী গঞ্জনা, নির্যাতন সয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে কিংবা আত্মঘাতী হয়।
তিনি ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চারটি পত্রিকায় প্রকাশিত ৪৪৬টি বিয়ের বিজ্ঞাপনের ওপর এ গবেষণা করেন। তার গবেষণায় উঠে এসেছে, সমাজে নারীর মূল্যায়নের এক বাস্তবিক উপাখ্যান। সেখানে দেখা গেছে, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পাত্রী সে, যার গায়ের রং ফর্সা। বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে ২২০টিতে অর্থাৎ ৪৯.৩২ শতাংশে সরাসরি গায়ের রং ফর্সা উল্লেখ করা হয়েছে। মাত্র ১৩টি বিজ্ঞাপনে পাত্রীপক্ষ পাত্রীর শ্যামলা রঙের কথা উল্লেখ করেছে। সুন্দরী, প্রকৃত সুন্দরী, অসামান্য রূপসী, রূপসী, অপূর্ব সুন্দরী- এ ধরনের বিশেষণ ব্যবহার করে সৌন্দর্যকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছে ২২২টি বিজ্ঞাপনে। অর্থাৎ ফর্সার চেয়েও বেশি ৪৯.৭৬ শতাংশ বিজ্ঞাপনে।
অন্যদিকে পাত্রীপক্ষ একটি মাত্র বিজ্ঞাপনে সুদর্শন পাত্র চেয়েছেন। অর্থাৎ পাত্রী এবং পাত্রপক্ষ নির্বিশেষে সবাই মনে করে বিয়ের পাত্রীকে অবশ্যই সুন্দরী হতে হবে। কিন্তু পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে অন্তত পাত্রীপক্ষের মাথাব্যথা নেই। মোট ৮৬টি বিজ্ঞাপনে সরাসরি লম্বা স্লিম বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করা হয়েছে, যা দৈহিক সৌন্দর্যের একটি সূচক।
শুধু তাই নয়, পাত্রপক্ষ পাত্রীর কাঙ্ক্ষিত উচ্চতাও বলে দিচ্ছে ইঞ্চি ফুট সমেত। আরেকটি সূচক হলো স্বাস্থ্যবতী। অর্থাৎ কোনোভাবেই মেয়েটির দৈহিক সৌন্দর্যের কোনো দিকই যেন ভুলক্রমে বাদ না পড়ে। তাই ৪৯.৭৬ শতাংশ বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যবতী মেয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪৪৬টি বিজ্ঞাপনের মাত্র ৪৪টিতে ভদ্র নম্র মার্জিত পাত্রী চাওয়া হয়েছে। অবশ্যই সুন্দরীও হতে হবে সেই পাত্রীকে। ৪৮টি বিজ্ঞাপনে ধার্মিক মেয়ে চাওয়া হয়েছে, যা শতকরা হিসাবে মাত্র ১০ শতাংশ।
আজকের পত্রিকায় পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপন দেখলেও দেখা যায়, ১৮ বছর আগের করা এই গবেষণার চিত্রটি এতটুকুও পাল্টায়নি। সেই সঙ্গে কমেনি রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন এবং বদলায়নি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
গ.
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিয়ে-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনকে গবেষণা করে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন এক প্রবন্ধে বলেন, পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন একটি সমাজে নর-নারীর ভূমিকা নির্দেশক। সেদিক থেকে দেখলে বৈবাহিক বিজ্ঞাপনে বড় কোনো পরিবর্তন না দেখাটাই স্বাভাবিক। কেননা, প্রধানত সমাজ-মানসের যে প্রকাশ আমরা শ্রেণিবদ্ধ (ক্লাসিফায়েড) বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই, সেখানে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো নারীর জন্য তার দৈহিক সৌন্দর্য, ঘরোয়া মনোভাব এবং পুরুষের জন্য অর্থ-বিত্ত-প্রতিষ্ঠাই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বিশ্বায়ন প্রবাসী পাত্র-পাত্রীর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে যে জনমিতিক পরিবর্তনটি বিজ্ঞাপনেও প্রতিবিম্বিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়া। আগের চেয়ে নারীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কিছুটা প্রভাব হয়তো বৈবাহিক বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, তার এককভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি মনে করেন, শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলো এখনো অসচেতন বা ছাঁচে ঢালা চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। তবে পৃথিবীতে এখন ডিসপ্লে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিয়ের সম্পর্কে যেসব পরিবর্তন প্রকাশের চেষ্টা দেখতে পাই, বাংলাদেশে তা চোখে পড়ে না।
অন্যদিকে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে কথিত বিয়ে নামক আবদ্ধে প্রায় ৭০-৮০ ভাগ নারী ধর্ষিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে বাড়িতে চেনাজানা পরিবেশে। এটিও যে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ। উভয়ের জন্যই বিয়ে হচ্ছে এমন একটি প্রথা যা শোষণের অনেক বড় একটা হাতিয়ার। আবার কখনো পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও পুরুষতন্ত্রের শিকার হচ্ছে বলে নীরবে খবর বাতাসে ওড়ে!
আপন মানুষ জানে না কিংবা মানে না। জীবনের ভেতর-বাহির কে কাকে দেখবে... কেউ নেই। এভাবে শত প্রশ্ন নিয়ে আমরা শুভ সকাল জানাই- অশুভ রাতে বালিশ ধরে রাখি। ঘুমিয়ে পড়ে বালিশ। এটাই একুশ শতক! উত্তরাধুনিকতা...
পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, যে যত বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিক, বাড়ি-গাড়ির মালিক হোক- এখনো এ সমাজে মানুষ হিসেবে নারী বা পুরুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি অভিভাবকদের বা সমাজের।
দিনে দিনে দেখা অদেখায় পণ্য সভ্যতার বিষ এভাবে ডুকে পড়ছে আমাদের সমাজে। হয়তো বুঝতে পারছি না, জানতে পারছি না। দীর্ঘস্থায়ী এ ক্ষতি সমাজচিন্তকদের চোখে আসছে না। বলে না কথা এ অন্ধকার নিয়ে।
পুঁজিতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে না, অধরা থাকবে আর কতকাল? আরও মনে রাখা ভালো, জ্ঞানদরিদ্র সমাজে চারিত্রিক ও মানসিক; জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি করতে হলে সত্যিকারের শিক্ষা আমাদের লাভ করতে হবে। দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের বিশালতায় উন্মুক্ত করতে হবে নিজেদের- বলাকার মতো।
এসইউ/এইচআর/পিআর