আমাদের জাতীয় খেলা কেন কাবাডি!
প্রথমেই বলে রাখি, দয়া করে এই লেখাটিকে রসিকতা হিসেবেই নিবেন। আমাদের জাতীয় খেলা, জাতীয় ঐতিহ্যকে হেয় করার বা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনরকম খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এটি লেখা হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো বাঙালি আর সব কিছু হজম করতে পারে, ফরমালিনযুক্ত খাদ্য, কারবাইডে পাকানো কলা, মবিলে ভাজা জিলাপি, কিন্তু সাধারণ রসিকতা হজম করতে পারে না। সেইজন্য গোপাল ভাঁড়ের পর আর সেই রকম রসিক ব্যক্তির কোন উল্লেখ পাই না। আমাদের ‘রম্য রচনা’গুলো পড়ে তাই পাঠকের মুখ চোখ আরও সিরিয়াস হয়ে ওঠে।
যাহোক মূল প্রসঙ্গে আসি। চীনদেশী ছাত্রছাত্রীদের বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজ পরিচিতি পড়ানো আমার কাজ। একদিন ক্লাসে পড়াচ্ছি বাংলাদেশের খেলাধুলা বিষয়ে। তাদের বললাম, বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট ও ফুটবল, জাতীয় খেলা কাবাডি।
ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলা হলো গোল্লাছুট, কানামাছি, দাড়িয়া বান্ধা, গোলাপ টগর ইত্যাদি। শুধু বললেই হবে না, খেলাগুলো কোনটা কেমন সেটা বুঝিয়েও দিচ্ছি। আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন কাবাডি কেন জাতীয় খেলা? ‘কাবাডি খুব ঐতিহ্যবাহী খেলা’ ইত্যাদি বলে ওদের বুঝিয়ে দিলাম বটে কিন্তু বাড়ি ফিরে আমার মনে প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে লাগলো।
সত্যিই তো, এত এত খেলা থাকতে কাবাডি জাতীয় খেলা হওয়ার মাজেজা কী? একটু পরই অবশ্য ফেসবুক দেখতে বসে দৈবদত্ত ওষুধের মতো উত্তরটিও মাথায় চলে এলো। দেখলাম, ফেসবুকে নারীবাদী বনাম নারীবাদী, সাহিত্যিক বনাম সাহিত্যিক, ব্লগার বনাম ব্লগার, পাতি রাজনীতিকর্মী বনাম সেমি পাতি রাজনীতিকর্মীর মধ্যে বেশ ক্যাচাল চলছে। বিশ্বকাপের মতো এই খেলাও জমে উঠেছে বলা যায়।
একজন একটু উন্নতি করলে বা এগিয়ে গেলেই দশজনে মিলে তারে চেপে ধরে টেনে নামানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমাদের টক শোগুলো দেখলেও একই কথা মনে জাগে। কোনো গঠনমূলক কথাবার্তা নেই, কে কার সঙ্গে কত বেশি গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে পারে আর কে কাকে টেনে নামাতে পারে তার প্রতিযোগিতার নামই টক শো।
দলবদ্ধভাবে অন্য মানুষের পিছনে লাগা যার আরেক নাম হচ্ছে গ্রুপিং সেটাও বাঙালির মজ্জাগত। মিডিয়া অফিস থেকে শুরু করে যে কোন জায়গায় দেখবেন গ্রুপিং আর গ্রুপিং। বিদেশে পাঁচজন বাঙালি একসঙ্গে থাকলেই দুটো গ্রুপ হয়ে যায়। দলবদ্ধভাবে কোনো একজন যে কিনা একটু এগিয়ে যাচ্ছে তাকে নিয়েও চলতে থাকে টানাটানি। সিনেমা জগত থেকে সাহিত্য জগত কোথাও টানাটানির আর পিছুলাগার অভাব নেই। ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ প্রবাদটি বাঙালির অভিধানেই পাওয়া যায়।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ‘মি টু আন্দোলন’ এবং বাংলাদেশে এর মুখ থুবড়ে পড়ার কথা। পরিচিত এক সিনিয়র আপা খুব আফশোস করে বলছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিটু আন্দোলন সফল হলেও বাংলাদেশে আন্দোলনটি সফল হতে পারেনি। কারণ এক নারী যাকে অভিযুক্ত করছেন, অন্য নারী তার সান্নিধ্যে আহ্লাদ করছেন।
ধরুন, আমারই কোন পরিচিত নারী অভিযোগ করলেন অমুক ক্ষমতাবান লোকটি যৌন নিপীড়ক। এই অভিযোগের কারণে নারীটি চাকরি হারালেন এবং বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হলেন। আমার উচিত নারীটির পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু কোথায় কী! আমি ভাবলাম, এই আমার সুযোগ। ওই মহিলা নিজের দোষে নির্যাতনের শিকার-টিকার হয়ে সরে গেছে, ভালোই হয়েছে। আমি এবার একটু ওই ক্ষমতাবানের গা ঘেঁষার সুযোগ পেয়েছি। জায়গা ফাঁকা থাকার সুযোগ নিয়ে আমি বরং এগিয়ে যাই ‘হা-ডু-ডু’ খেলার ভঙ্গিতে।
‘বিয়েতে ভাংচি’, বসের কাছে অন্যের নামে ‘কুটনামি’, প্রতিবেশীর নামে কুৎসা রটনা, ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা, অন্যের গরুকে ধরে খোঁয়াড়ে দেওয়া, পরের পুকুরে বিষ দেওয়া ইত্যাদিও আমাদের মারাত্মক ঐতিহ্য। অন্যদেশে, অন্য জাতির মধ্যে এসব দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও চোখে পড়ে না।
রাজনৈতিক অঙ্গনে কাদা ছোঁড়াছুড়ি বিশ্বের প্রায় সবদেশে কমবেশি চোখে পড়লেও একজন উন্নতি করলে আরেকজনের তার পা ধরে টেনে নিচে নামানোর মরিয়া প্রবণতা বাঙালির একান্ত আপন গৌরব। আমাদের এতগুলো জাতীয় বৈশিষ্ট্য যে খেলা ধারণ করেছে সেটি যে জাতীয় খেলা হবে তাতে আর আশ্চর্য কি!
এখন একটা কথা বলি। কসম খোদার, এই লেখার সঙ্গে জীবিত, মৃত, অর্ধ জীবিত, প্রবাসী, স্বদেশী, অনাবাসী, পরিচিত-অপরিচিত কারও কোন সম্পর্ক ও সাদৃশ্য নেই। আমাকে টেনে কোনও লাভ নেই, কারণ আমি কাবাডি খেলায় বড়ই আনাড়ি, দমও ধরে রাখতে পারি না, টানাটানিতেও দুর্বল।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।
এইচআর/জেআইএম