মানুষ কেন নিষ্ক্রিয়?
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ৩০ জুন ২০১৯
একজন মানুষকে প্রকাশ্যে রাস্তার উপর কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, তার দেহ থেকে ঝরছে রক্ত। তার স্ত্রী হত্যাকারীদের বাধা দিতে চাচ্ছে মরিয়া হয়ে, কান্নাকাটি করছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। অথচ রাস্তাটি মোটেই জনহীন নয়। সেখানে মানুষ নামের কিছু অমানুষ রয়েছে। তারা মোবাইলে ভিডিও তুলছে। তারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। অথচ তারা কেউ হত্যাকারীদের রুখতে এগিয়ে আসছে না।
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে কোনদিকে যাচ্ছি আমরা? এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে পুরানো ঢাকায় বিশ্বজিত দাশ নামের একটি তরুণকে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হয় তখনও প্রকাশ্য দিবালোকে বহু মানুষের চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটে। এমনকি কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও সেখানে ছিল। বিশ্বজিতকে হত্যা করার দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছিল। কিন্তু তাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
একইভাবে অনেক মানুষের চোখের সামনে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ফুটপাতের উপর মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী বন্যা হত্যাকারীদের প্রতিহত করতে গিয়ে নিজেও গুরুতর আহত হন। তখনও এই হত্যাকাণ্ডকে প্রতিহত করতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
বেশ অনেক বছর আগে থার্টিফাস্ট নাইটে যখন বহু মানুষের এবং ফটো সাংবাদিকদের চোখের সামনে টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় একজন নারীর উপর যৌন হামলা চালানো হয় তখনও ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল কয়েকজন। মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউ।
এর বিপরীতে মনে পড়ছে ব্লগার ওয়াশিকুরকে হত্যা করে পালানোর সময় হত্যাকারীদের ঘেরাও করে ধরে ফেলেন কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। পহেলা বৈশাখে নারীদের উপর যৌন হামলার সময় অপরাধীদের বাধা দিতে এগিয়ে আসেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা লিটন নন্দী। তিনি সেসময় আহতও হন।
তবে বাধা দেওয়ার ঘটনার চেয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার ঘটনাই বেশি। ক্রমশ এই নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে। চোখের সামনে ভয়াবহ অপরাধ ঘটতে দেখলেও কেউ এগিয়ে আসছে না, বরং মোবাইলে ছবি তুলছে।
সড়ক দুর্ঘটনার বেলাতেও এ ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। একটি যাত্রীবাহী বাস পথচারীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাসের ভিতরে বসে থাকা যাত্রীরা চালককে বাধা না দিয়ে, আটক না করে দিব্যি নিষ্ক্রিয়ভাবে বাসের ভিতরে বসে থাকছে। এমন ঘটনা একটি বা দুটি নয়, অসংখ্য।
কেন এমন ঘটছে? অন্যায়কে প্রতিহত করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রকাশ্যে একজন মানুষের উপর হামলা ঘটলে অন্য মানুষরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রটা কেন দেখা যাচ্ছে?
২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অতনু ঘোষ পরিচালিত কলকাতার বাংলা ছবি ‘এক ফালি রোদ’ এর কাহিনি মনে পড়ছে। এই চলচ্চিত্রে একজন সমাজ বিজ্ঞানীর গবেষণার সূত্র ধরে এই প্রশ্নটি খুব জোরে-শোরে তুলে ধরা হয়েছিল।
অপরাধ প্রতিরোধ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু কখন এই প্রবৃত্তি স্তিমিত হয়ে বিপরীতটা দেখা যায়? যখন মানুষ তার নিজের সামাজিক কর্তব্য সম্পর্কে কনফিউজড হয়ে যায়। যখন সে মনে করে ‘আমি কেন এগিয়ে যাবো? অন্যরা যাক’। অথবা মনে করে ‘কী দরকার ঝামেলায় জড়িয়ে’। মানুষ যখন মনে করে সে অপরাধ প্রতিরোধে এগিয়ে গেলে পরবর্তিতে পুলিশের ঝামেলায় পড়বে বা পুলিশ হয়তো তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে বসবে তখন সে আতংকে ভোগে।
আবার মানুষের মানবিক বোধের যখন অবক্ষয় ঘটে তখনও সে অন্য মানুষকে সাহায্য করার পরিবর্তে নিষ্ক্রিয় আচরণ করে। বিশ্বজিত হত্যার সময় টিভি ফুটেজ যারা ধারণ করছিলেন, ছবি তুলছিলেন তারাও যদি প্রতিরোধে এগিয়ে যেতেন তাহলে একজন মানুষের জীবন বাঁচতো। কিন্তু জীবন বাঁচানোর চেয়ে হত্যার দৃশ্য ধারণ তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল হয়তো!
মূল প্রসঙ্গ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে একটি পুরনো প্রশ্ন আবার তুলে ধরি। আমি কি প্রথমে একজন মানুষ নাকি একজন সাংবাদিক? একজন মানুষকে মৃত্যুর মুখে দেখলে আমি কি তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাব নাকি ভিডিও ফুটেজ তুলতে থাকবো? ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি আমি আগে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাব।
রিফাত হত্যার ক্ষেত্রে বলা যায়, যারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল, মোবাইলে ছবি তুলছিল তারা যদি তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে যেত তাহলে তরুণটির জীবন বেঁচে যেত।
এই নিষ্ক্রিয় থাকার প্রবণতা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে তুলে ধরে। এই অবক্ষয় কত বিধ্বংসী, কত ভয়াবহ দিকে যাচ্ছে সেকথা ভেবে দেখার সময় এসেছে বৈকি।
আরেকটি কথা। রিফাত হত্যার পর অনেকেই তার স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলছেন। যারা আঙুল তুলছেন তাদের বিকৃত মানসিকতার প্রতি ঘৃণা ও করুণা ছাড়া আর কিছু নেই। একজন মানুষের সঙ্গে প্রেম বা বিয়ে, ডিভোর্স, সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া কোন অপরাধ নয়। অপরাধ এবং ভয়াবহ অপরাধ হলো মানুষকে হত্যা। স্ত্রী যে রিফাতকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সেখানেই তার নির্দোষিতা প্রমাণ হয়ে যায়। শুধু নির্দোষিতা নয়, তার সাহসের প্রশংসাও করতে হয়।
আর মানুষকে হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ যে নরপিশাচরা করেছে তাদের চরম শাস্তি দাবি করা সম্পূর্ণ যৌক্তিক। রিফাতের হত্যাকারীদের চরম শাস্তি দাবি করছি। সেইসঙ্গে মানুষের মানবিক বোধের উদয় হোক, অপরাধ প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটুক সেটাই কামনা। ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’ এই গুরুবাক্যের পর আর কিছু বলার নেই।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।
এইচআর/জেআইএম
মানুষকে হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ যে নরপিশাচরা করেছে তাদের চরম শাস্তি দাবি করা সম্পূর্ণ যৌক্তিক। রিফাতের হত্যাকারীদের চরম শাস্তি দাবি করছি। সেইসঙ্গে মানুষের মানবিক বোধের উদয় হোক, অপরাধ প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটুক সেটাই কামনা। ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’ এই গুরুবাক্যের পর আর কিছু বলার নেই।