যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এলো বিশ্ব
গত শুক্রবার ২১ জুন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগের দিন ইরান তার আকাশসীমায় গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছিল। এটা কোনও সাধারণ ড্রোন ছিল না। ১৩০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই ড্রোন ৬০ হাজার ফুট ঊর্ধ্ব আকাশ থেকে ছবি তুলতে সক্ষম। সর্বশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি। ড্রোনটি ইরানের হাতে বিধ্বস্ত হওয়ায় আমেরিকা বিস্মিত হয়েছে কারণ এতে ইরানের সুনিপুণতা প্রমাণ করে।
আমেরিকা মনে করেছিল এই ড্রোন ভূপাতিত করার জন্য ইরান রাশিয়ার এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল ব্যবহার করেছে। কারণ এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রই একমাত্র অভ্রান্তভাবে এই ড্রোন ভূপাতিত করতে পারে। অথচ দেখা যাচ্ছে ইরানের হাতে এস-৪০০ রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র নেই। ইরান এই মিসাইল কেনার প্রস্তাব করেছিল সত্য কিন্তু রাশিয়া বিক্রি করতে সম্মত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ হওয়ার পর রাশিয়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র এখন সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন। রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াই ইরান এই ড্রোন ভূপাতিত করেছে। এ তথ্যটা পেন্টাগনকে আরও অবাক করবে।
আরব সাগরে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ইউনিট যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইরান আক্রমণের নির্দেশ পালন প্রস্তুতির শেষ লগ্নে উপস্থিত তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আক্রমণের নির্দেশ স্থগিত করেছিলেন। কেন স্থগিত করেছিলেন আর স্থগিতাদেশটা কি সামরিক- এই নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখনো জল্পনা-কল্পনা চলছে। যুদ্ধ যদি হয় গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো কে কার দিকে অবস্থান নেবে এই নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে পাঠকদের একটু জানাতে চাই যে, ২০০৩ সালে ইরাক-মার্কিন যুদ্ধের সময় আমি প্রায় দুই মাস ব্যাপী রণাঙ্গন থেকে যুদ্ধের রিপোর্ট করেছিলাম। হয়তো অনেকে সেটা জানেনও। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজ আমাকে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ সরবরাহ করার জন্য বাগদাদ পাঠিয়েছিল। আমি শুধু আজকের কাগজ নয়- বিবিসি বাংলা এবং জার্মান ডয়চে ভেলে রেডিও আর বাংলাদেশের চ্যানেল আইতেও যুদ্ধ সংবাদ সরবরাহ করেছিলাম। দক্ষিণ এশিয়া থেকে আমি এবং ভারতের একজন সাংবাদিক শুধুমাত্র সেখানে ছিলাম তখন। মার্কিনীরা ইরাক আক্রমণকালে ইরান জড়িত হয়নি কিন্তু এখন ইরান আক্রমণ করলে ইরাকের ভূমিকা ইরানের পক্ষে যাবে।
ইরান আর ইরাক পাশাপাশি রাষ্ট্র। ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর ইসলামিক বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য মার্কিনীরা তাদের বকলমে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বছর যুদ্ধ চালিয়েছিল। সেই যুদ্ধেও ইরানকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত ইরানের শাহানশাহ রেজা শাহ পাহলভীর ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি ডলার ছিল। ইরান আমেরিকার কাছে তা ফেরত চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এ টাকা ফেরত না দেওয়ায় ইরান তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে ৫২ জন দূত এবং মার্কিন নাগরিককে ৪৪৪ দিন বন্দি করে রেখেছিল। এই ৫২ জনকে আমেরিকা রেজা শাহের অর্থ আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় ফেরত দিয়ে মুক্ত করেছিল। এটাও ছিল মার্কিনীদের পরাজয়।
মার্কিনীদের স্টকে এমন বহু পরাজয়ের গ্লানি জমা হয়ে আছে যার প্রতিশোধ তারা ইরানের উপর থেকে নিতে পারেনি। সর্বোপরি মার্কিনীরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোকে একে একে ধ্বংস করছে কিন্তু ইরানকে কী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কী ইসরায়েল- কেউ এখনো স্পর্শ করতে সক্ষম হয়নি।
দীর্ঘদিন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সোচ্চার হয়েছিলেন এই বলে যে, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে সুতরাং তার পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র গুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হোক। না হয় ইসরায়েল নিজেই তা ধ্বংস করে দেওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করেছিল। ২০১৫ সালে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স অর্থাৎ জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য এবং জার্মানি দীর্ঘ আলোচনা করে ইরানের সঙ্গে একটা চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তি অনুসারে ইরান তার পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র গুলো বন্ধ করবে না তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ব্যবস্থা বোমা বানানোর পর্যায়ে নেবে না।
এ বিষয়টা বিশ্ব আণবিক শক্তি কমিশন তিন মাস পর পর মনিটরিং করবে। ইরান চুক্তি মেনে নেওয়ায় জাতিসংঘসহ সবাই ইরানের উপর স্থাপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। পরবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং নির্বাচিত হয়ে তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিরোধিতা করে চুক্তি থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন।
ইরানের উপর পুনরায় কঠিন বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করেন কিন্তু চুক্তিতে শর্ত ছিল বাণিজ্যিক অবরোধ প্রত্যাহার না করলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করার অধিকার ভোগ করবে। আমেরিকা তার নাম প্রত্যাহার করায় এই চুক্তির অবশিষ্ট স্বাক্ষরকারীরা বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ না করার আহ্বান জানান।
গত এপ্রিল মাসে আমেরিকা আরব উপসাগরে তার বিমানবাহী রণতরী আব্রাহাম লিংকন প্রেরণ করে এবং পরবর্তীতে এন্টারপ্রাইজও গিয়ে উপস্থিত হয়। ইরানও আরব উপসাগর এবং ওমান উপসাগরে তার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আরব উপসাগরে ছোট ছোট রণতরীতে মেশিনগান বসিয়ে সারা উপসাগরে আমেরিকার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে ধরে রেখেছে।
আরব উপসাগরে আমেরিকার যুদ্ধ প্রস্তুতি দৃশ্যমান করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। ইরানীদের এক কথা বাণিজ্য অবরোধ প্রত্যাহার ছাড়া কোনও আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, আমেরিকা তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আবার গত সপ্তাহে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আলোচনার জন্য প্রস্তাব দিয়ে এসেছিলেন। ইরান একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। রণ যাত্রা বন্ধ করার পর আমেরিকা গত ২৪ জুন ইরানের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটারের উপর হামলা চালিয়েছিল। তেহরান জানিয়েছে তারা মার্কিনিদের সাইবার হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
ইরানের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ট্রাম্প সর্বশেষ ২৩ জুন ইরানের শীর্ষ নেতা খামেনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফসহ রেভল্যুশনারি গার্ডের ৮ শীর্ষ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারির নির্বাহী আদেশে সই করেন। যারা খামেনি এবং তার কার্যালয়কে সহায়তা দিয়ে থাকে তারা এই নিষেধাজ্ঞার আওয়ায় পড়বে। ইরান বলেছে এর ফলে আলোচনার কূটনৈতিক দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল। ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেছেন, হোয়াইট হাউসের এই পদক্ষেপের অর্থ হল তারা মানসিক বিকারগ্রস্থ। ট্রাম্প এটা শুনে আরও ক্ষেপেছেন।
এখন প্রশ্ন তুলতে পারি ট্রাম্প যুদ্ধের আদেশে সই করেও যুদ্ধ থামিয়ে দিলেন কেন? তার কথায় হামলা হলে ১৫০ লোক তাৎক্ষণিক মারা যেত এই কারণে? আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় ট্রাম্প হয়তোবা সৌদি আরবের পরামর্শে যুদ্ধ বন্ধ করেছেন। ইরানের আক্রমণের লক্ষ্য মার্কিন রণতরী যেমন হবে ঠিক সৌদি আরবও হবে। হয়তোবা সৌদি আরব নিজের উপর আক্রমণকে স্থগিত করায় উত্তম মনে করেছে। অয়েল ট্যাংককে দুই দফা আক্রমণ করেছে মনে হয় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইরান ওই আক্রমণ করেছে এমন কোনও জোরালো প্রমাণ আমেরিকা এবং তার আরব মিত্ররা দিতে পারেনি। ইসরায়েল উপসাগরে একটা যুদ্ধ কামনা করে।
এখন ভুল বোঝাবুঝিতে একটা যুদ্ধ লেগে যাক তাই চাচ্ছে ইসরায়েল। আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার প্রায় ১৭টি বই লিখেছেন। তিনি তার অনেক লেখায় বলেছেন আমেরিকাকে দিয়ে ইসরায়েল তার অভিলাষ পূরণ করতে চায় সব সময়। ইসরায়েল যদি তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি ও সমঝোতায় বসবাস না করে তবে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হবে এ শতকের পাঁচ দশকের দিকে। বন্ধু বলতে এখন ট্রাম্পের জন্য সৌদি আরব, ইসরায়েল আর আরব আমিরাত ছাড়া আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। ইসরায়েলী লবি ট্রাম্পকে ইসরায়েলের ক্রীড়ানক বানিয়ে ছেড়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/পিআর