‘ঘরের কথা বাইরে জানে ক্যামনে’
শনিবার বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়ে গেলো গুলশানে। দেড় মাস বিরতির পর আগের শনিবার বৈঠকেরই মুলতবি সভা ছিল এটি। সপ্তাহকাল পরে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও এই সভাটি ছিল বিএনপি সংশ্লিষ্টদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দলের ভিতরে লেগে থাকা জট খোলার জন্য চেষ্টা করা হবে, এমনটা আগে থেকেই জানা গিয়েছিল বলে।
নির্বাচন পরবর্তীকালে নেতাদের মধ্যে জমে ওঠা ক্ষোভ প্রশমনের জন্য অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ এবং দলীয় গোপনীয় কথাবার্তা ইতোমধ্যে ফাঁস হয়ে যায় সংবাদ মাধ্যমে। সঙ্গত কারণেই বিএনপি মহাসচিব গত শনিবারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তথ্য ফাঁসের কারণে। এটা স্বাভাবিক দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি আসবেই। সেখানে বাক-বিতণ্ডা হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। যা হয়েছিলো আগের বৈঠকে।
সাংবাদিকদের কোনো গোপন ভিডিও ক্যামেরা সেখানে ছিল না। কিংবা বাইরের কেউ সেখানে উপস্থিতও ছিল না, তারপরও যখন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও মির্জা ফখরুল ইসলামের মধ্যে বাদানুবাদের কথা মিডিয়ায় প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন স্বাভাবিক কারণেই মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রশ্ন তোলতে পারেন- কে সেই ইঁদুর, যে নাকি বেড়া কাটছে? প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সিনিয়র এক নেতা তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেছেন- ‘কেউ হয়তো ব্যক্তিক্ষোভ মেটাতে এসব কথা মিডিয়ায় প্রচার করেছেন।’
স্কাইপে মাধ্যমে লন্ডন থেকে তারেক রহমানও অংশ নিয়েছিলেন বৈঠকে। তিনি জানলেন, দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেই কিছু ইঁদুর রয়ে গেছে, যে নাকি নিজেদের বেড়া কাটছে। এমন সময় এই বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটলো যে মুহূর্তে স্থায়ী কমিটির দুই নতুন সদস্য প্রথম অংশ নিলেন ওই বৈঠকে। সদ্য নিযুক্ত দুই সদস্য নিয়ে এর আগেই দলের সমর্থকদের বিস্ময়ের কথা প্রকাশ হয়েছে। কিছু সংবাদ মাধ্যমে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, নতুন দুই সদস্য কি দলের গোপনীয়তা রক্ষা করতে সক্ষম হবেন? সেক্ষেত্রে তাদের পারিবারিক বিষয়টিকেও টেনে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিএনপির নেত্রী সেলিমা রহমানের কথা। তিনি সরকারি মহাজোটের অন্যতম দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি’র বোন।
অন্যদিকে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আওয়ামী লীগের নেতা শেখ সেলিম ও প্রয়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে নাহিম রাজ্জাকের নিকটাত্মীয়। যিনি আবার ছাত্রলীগ থেকে জাতীয় পার্টি হয়ে বিএনপিতে আসা নেতা। বিএনপির আন্দোলনে সেলিমা রহমানকে নিকট অতীতে প্রায় সবসময় দেখা গেলেও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে তেমন একটা দেখা যায়নি।
দলের ভিতরেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে। বিশেষ করে বিএনপির কঠিন দুর্দিনে যখন আন্দোলন করার মতো নেতা পাওয়া যেতো না, পুলিশী হয়রানিতে যখন নেতারা জর্জরিত তখন যেসব নেতাকে মাঠে দেখা গেছে, তারা বঞ্চিত হয়েছেন এমনটাই মনে করছেন। প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ হয়ে পড়েছে সংবাদ মাধ্যমে। নতুন দুই সদস্য নিযুক্ত হওয়ার পরপর প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। দলের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বাধ্য এমনই ছিল তাঁর বক্তব্য। তাঁর বক্তব্যকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। তিনি কিন্তু সরাসরি বলেননি, সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে। আবার ভালো হয়নি এটাও বলেননি কিংবা দলের ত্যাগী নেতাদের সদস্যভুক্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাও প্রকাশ করেননি। ডিপ্লোমেটিক মন্তব্য হিসেবেই গণ্য করা যায় তাঁর বক্তব্য।
এদিকে নিকট অতীতের সব আন্দোলনে সামনের কাতারে থাকা শামসুজ্জামান দুদু মূলত হাই কমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষাতেই আছেন। কর্মীদের আশা ছিল অন্তত দুটি শুন্য পদও যদি পূরণ করা হয়, তাহলে শামসুজ্জামান দুদুর নামটি হয়তো থাকবে। কারণ তিনি বহিরাগত নন। ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে যার শুরু, নিজ যোগ্যতাবলেই আজকে সিনিয়র অবস্থানকে নিশ্চিত করেছেন। আর দলীয় স্বীকৃতিকে তিনি দলের জন্যই কাজেও লাগিয়েছেন।
কিন্তু অপর ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর দ্বিতীয়বারের মতো বঞ্চিত হয়েছেন বলেই মনে করা হয়। সেইজন্যই হয়তো তার প্রতিক্রিয়াটি চমকে দেওয়ার মতো। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয়বাদী দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তাকে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখনো স্থায়ী কমিটির দুটি পদ শুন্য ছিল। তখনো আলোচনা চলছিল তিনি হয়তো স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ পেতে যাচ্ছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে দীর্ঘদিন চলে গেলেও তিনি পদ লাভ করেননি। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীরউত্তম খেতাব পাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধার স্থায়ী কমিটিতে স্থান না পাওয়ার জন্য তখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি জামায়াতের প্রতি বিএনপির ঝুঁকে যাওয়াকে অনেকেই দায়ী করেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না হলেও বিএনপি নিজে চলার চেষ্টা করছে, শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হওয়ার পর অনেকেরই ভাবনায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। সেই সুবাদে শাহজাহান উমরের পথ প্রশস্ত হয়েছিল এমনটা বলা যায়ই।
বাস্তবতা হচ্ছে- তিনি এবারও স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। এখনো স্থায়ী কমিটিতে তিনটি শুন্য পদ রয়েছে। সন্দেহ তৈরি হয়েছে- বীর এই মুক্তিযোদ্ধা এবারও সদস্যভুক্ত হতে পারবেন কিনা। হয়তো বা তিনি নিজেও এই আশঙ্কাটা করে থাকতে পারেন। যা বোঝা যায় তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া থেকে।
সংবাদ মাধ্যমে তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ হয়েছে অতি সম্প্রতি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশকালে বলেছেন,‘ আমার দ্বারা হয়তো এ দল করা সম্ভব হবে না।’ ( জাগো নিউজ, ১৯ জুন, ২০১৯) একজন নেতার এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর বোঝা যায়- ভিতরের ক্ষোভ গণমাধ্যমে কিভাবে আসে।
এমতাবস্থায় মির্জা ফখরুল ইসলাম নিশ্চয়ই বোঝার কথা, কিভাবে তাদের দলের গোপনীয়তা প্রকাশ পায়। আর যে বৈঠকে মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মধ্যে তর্ক পাল্টা তর্ক হয়েছিলো সেই মতভেদের বিষয়টিতো আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত। একাদশ সংসদে নির্বাচিত বিএনপির এমপিদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তকে প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। একইভাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম কেন শপথ নেননি সেই প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে বিএনপি নেতাদের মুখ থেকেই।
স্থায়ী কমিটিকে পাশ কাটিয়ে বিএনপি যখন তাদের এমপিদের সংসদে পাঠায় তখন স্থায়ী কমিটির সিনিয়র নেতারাই সমালোচনামুখর হয়েছিলেন। কেন স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে এমপিগণ শপথ নিলেন সেই জবাব দিতে হবে বলে তারা জনসমাবেশেই জানিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কি কি আলোচনা হতে পারে সেটা যে কারো বোঝার কথা। এবং গণমাধ্যমে সেই সত্যটিই প্রকাশ হয়েছে।
সুতরাং মির্জা ফখরুল ইসলামের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জবাব তো আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেছে। এবং তা করেছেন তারই দলের নেতৃবৃন্দ। সুতরাং ভিতরের কথা কিভাবে বাহিরে যায়, তা বোধ করি অনুধাবন করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।
এইচআর/এমকেএইচ