নারী-মস্তিষ্কের ‘সক্রিয়তা’

নাসরীন মুস্তাফা
নাসরীন মুস্তাফা নাসরীন মুস্তাফা
প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ২২ জুন ২০১৯

আলঝেইমার রোগের উপর একটি আন্তর্জাতিক জার্নাল আছে, যার নামই হচ্ছে `দ্য জার্নাল অব আলঝেইমার’স ডিজিজ। কিছু দিন আগে এই জার্নালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তার সাথে মানুষের মস্তিষ্কের স্ক্যান করা একটি ছবি। স্ক্যানের ছবিতে আছে মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ, তাতে মৌলিক রঙ দিয়ে বোঝানো, লাল রঙের জায়গাগুলোতে বেশি বেশি রক্ত প্রবাহন ঘটে কেবল নারীর মস্তিষ্কে। অল্প একটু নীল রঙের অংশ দেখা যাচ্ছে, যেখানে বেশি রক্ত প্রবাহের ঘটনা ঘটে কেবলমাত্র পুরুষের মস্তিষ্কেই।

ফলাফল হিসেবে ব্যাখ্যাটা এসেছে এরকম- নারীর মস্তিষ্কের সক্রিয় এলাকার অংশ পুরুষের মস্তিষ্কের চেয়ে অনেকখানি বেশি। এতে খুশি হওয়ার কারণ নেই। গবেষকরা ফলাফলের উপর দাঁড়িয়ে বলছেন, বেশি সক্রিয় মস্তিষ্ক আছে বলেই নারীরা উদ্বেগ, হতাশা, নিদ্রাহীনতা আর খাবারে অরুচির মতো সমস্যায় ভোগেন বেশি।

ক্যালিফোর্নিয়ার আমেন ক্লিনিকের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার সাথে জড়িত। সিঙ্গল ফোটন এমিশন কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি বা এসপিইসিটি’র সাহায্যে অসীম ধৈর্য্যের সাথে এই বিজ্ঞানীরা ৪৬,০০০ নারী-পুরুষের মস্তিষ্কের স্ক্যান করে নারী ও পুরুষের মস্তিষ্কের ভিন্নতা বোঝার চেষ্টা করেছেন। এই ভিন্নতা বুঝতে পারাটা খুব জরুরি, আমার মতো সাধারণ মানুষও বোঝে, বিজ্ঞানীরা তো বুঝেছেনই, সমাজে নারী ও পুরুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যই এই বোধগম্যতার দরকার আছে।

গবেষকরা পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা আর জীবনযাপনের জটিলতা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে বলে এর ক্ষতিকর প্রভাব নারী ও পুরুষ কার উপর কতটা পড়ছে, কীভাবে পড়ছে, তা বুঝতে চাইছেন। উদাহরণ দিয়ে বলি, নারীদের আলঝেইমার রোগ হওয়ার প্রবণতা পুরুষের চেয়ে বেশি। হতাশা-উদ্বেগের বোঝাও নারীর ঘাড়েই চেপে বসে বেশি। পুরুষের ঝামেলা হচ্ছে মনোযোগ দিতে না পারার অক্ষমতা বা attention deficit hyperactivity disorder (ADHD), সামাজিক যোগাযোগ প্রকাশের অক্ষমতাও।

নারীর প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে বেশি রক্ত প্রবাহিত হয়, পুরুষের ততটা হয় না। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের সক্রিয়তার উপর নির্ভর করে কোন বিষয়ে কে কতটা মনোযোগ দিতে পারছে, আবেগের উপর কার কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে, মানসিক ভাব বা মুডের জন্য দায়ী মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণই বা কতটুকু থাকছে। নারীর মস্তিষ্ক বেশি সক্রিয় যে যে এলাকায়, সেগুলো বিষয়ের উপর তাকে বেশি মনোযোগ দিতে সাহায্য করে, আবেগি বানিয়ে দেয়, মুড আর উদ্বেগের হার বেশি করে ফেলে।

অন্যদিকে মস্তিষ্কের নীল রঙের এলাকায় পুরুষের সক্রিয়তা থাকায় দৃশ্য দেখার এবং সেই দৃশ্যমানতার সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ ঘটাতে পুরুষ বেশি পারঙ্গম। এ থেকে আন্দাজ করা যায়, কেন নারী মমতাময়ী, সহায়তাপ্রবণ, অন্যের সমস্যা সমাধানে বেশি মনোযোগী। আবার কেন নারী অল্পতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, রেগে ওঠেন, শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন, তা বুঝতেও কষ্ট হয় না। তবে মানুষের বিবর্তনের ধারা যেহেতু চলছে, পারিপার্শ্বিকতা যেহেতু বিবর্তনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই বিশ্ব বদলে যাচ্ছে বলে চিরকালীন নারীর মস্তিষ্কের সহজাত প্রবণতাও যে বদলে যাবে না, তার কিন্তু নিশ্চয়তা নেই।

মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করে খ্যাতিমান হয়ে ওঠা বিজ্ঞানী গিনা রিপন বলেছেন, মস্তিষ্ক নিয়ে গত ৪০ বছর আমরা যেটুকু বোধগম্যতা অর্জন করতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক বুঝি প্লাস্টিকের বা তুলতুলে নমনীয় আর গোটা জীবন এরকমই থাকে। নানা রকমের স্বল্প আর দীর্ঘ মেয়াদী অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের গঠনকে বদলে দেবে।

দেখা গেছে, সামাজিক প্রবণতা আর আকাঙ্খার গড়পড়তা প্রথাগত ধারণা মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়া করার কাজটি কোন্ পদ্ধতিতে হবে, তা বদলে দিতে পারে। শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, এমনকি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের মতো নানা রকমের ফ্যাক্টর এসে সময়, জায়গা আর সংস্কৃতির মতো ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মিশ্রণে মস্তিষ্কে আচরণগত আর বাচনিক দক্ষতার ভিন্নতা গড়ে দেয়। ঠিক এই জায়গাটাতে এসে আমি আমাদের দেশের তরুণ নারী প্রজন্ম এবং কন্যাশিশুকে নিয়ে গভীর স্বপ্ন দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠি।

বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো নানা সূচক দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের অগ্রগতি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের কথা বলছে। অগ্রগতি ঘটছে বলেই এর সুফল নারীর মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াবে আরও বেশি। নারীর ক্ষমতায়নে এর প্রভাব পড়বে প্রত্যক্ষভাবে।

লিঙ্গ ভিন্নতায় বাংলাদেশের পুরুষ কি পিছিয়ে পড়বে? মোটেও না। অগ্রগতির প্রভাবে পুরুষ মস্তিষ্ক ইতিবাচক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যা সমৃদ্ধ বাংলাদেশেরই চালিকাশক্তি হয়ে গেছে, উত্তরোত্তর এর মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। এই আশাবাদ বাস্তবে রূপ নেবে তখনি, যখন সঠিক পরিকল্পনা সচেতনভাবে মানবসম্পদের গুণগতমান বাড়াতে সচেষ্ট হবে। পরিকল্পিত বাংলাদেশে এর অভাব না ঘটুক, এ আশাবাদ করছি।

লেখক : সাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো নানা সূচক দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের অগ্রগতি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের কথা বলছে। অগ্রগতি ঘটছে বলেই এর সুফল নারীর মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াবে আরও বেশি। নারীর ক্ষমতায়নে এর প্রভাব পড়বে প্রত্যক্ষভাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।