বাংলাদেশ : দেশান্তরকামী মানুষের এক ভূখণ্ড

তানজীনা ইয়াসমিন
তানজীনা ইয়াসমিন তানজীনা ইয়াসমিন , কলামিস্ট, গবেষক
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ২০ জুন ২০১৯

সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের এক ভিডিও ক্লিপে খুব ছি ছি ঝড়ের আঁচ পেলাম। অথচ অনেক খুঁজে ভিডিওটি পেলেও তাতে প্রবাসী শ্রমজীবী মানুষদের জন্য তার গভীর মমতা আর দেশের প্রতি তাদের আকুলতার চিত্রায়ন ছাড়া কিছুই পাইনি।

মূলত বাংলাদেশের ইতিহাসই হল অভিবাসনের ইতিহাস। শতাব্দী ধরে বাংলার বদ্বীপ অঞ্চলগুলিতে মানুষ যাযাবর। সমকালীন শ্রম মাইগ্রেশন প্যাটার্ন যেন ঔপনিবেশিক সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায় । প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লক্ষ বাংলাদেশী কর্মসূত্রে বা ভাগ্যান্বেষণে বিদেশ পাড়ি দেয়। আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতি অভিবাসীদের রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বে ৭ম শীর্ষস্থানীয় রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশ। এই ডায়াসপোরার সদস্যদের পাঠানো অর্থ তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতিতে যেমন স্বতঃস্ফূর্ত অবদান রেখেছে, তেমনি ২০১৩ সালে ১৩৮ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স অর্জিত হয়েছে , যা মোট প্রবৃদ্ধির ৯ শতাংশেরও বেশি।

শ্রম মাইগ্রেশন:
বৃটিশ রাজের রাজত্বকালে মগের মুল্লুকে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পানিপথে শ্রমিক প্রেরণের কাল পার হলে প্রবলভাবে এই মাইগ্রেশন শুরু ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর। যুক্তরাজ্যকে তখন শ্রম ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয়, শুরু হয় কমনওয়েলথ রাজ্যের শ্রম অভিবাসীদের আকৃষ্ট করা। বাংলাদেশের তরুণ শ্রমশক্তি, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল থেকে তখন যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায় এবং এদের অধিকাংশই লন্ডনে বসতি স্থাপন করে যুক্তরাজ্যের সস্তা শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে অবদান রাখে।

দেশ স্বাধীন হবার পর, বিশেষত ১৯৭৩ সালে তেলের বাজার চাঙ্গা হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের সস্তা শ্রমের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম মাইগ্রেশন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৬ এ প্রাথমিকভাবে মাত্র ৬০০০ বাংলাদেশী প্রবাসে পাড়ি জমালেও সেই থেকেই স্থায়ী অভিবাসী, অস্থায়ী বহিরাগত শ্রমিক উভয়েরই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। শুধু ২০০৮ এই ৮,৭৫,০০০ অভিবাসী কর্মী প্রেরণ করেছিল বাংলাদেশ।

উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল সংস্থা (জিসিসি) বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। । ২০০৫ থেকে ২0১০ পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলি ১৫ লক্ষ বাংলাদেশী শ্রমিককে আকৃষ্ট করেছিল, যা বাংলাদেশের সকল আন্তর্জাতিক বহির্গমনের ৫২ শতাংশ। এদের মধ্যে বেশিরভাগই সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং কাতার। আবার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১২ তে পুরুষ শ্রম অভিবাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেখানে পুরুষ বাংলাদেশি শ্রমিক সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়ে মহিলা শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে।

একই সময়ের মধ্যে ভারতেও ৬,৩১,০০০ এরও বেশি বাংলাদেশী নিবন্ধিত হয়েছে । অনেকেই অনথিভুক্ত আছেন এবং এর ফলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয় এবং উভয় রাজ্যের সদস্যদের সীমানা ক্রসিং মজবুত হয়। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা রাজ্যের বাংলাভাষী মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রবাহ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনার বিষয়। এদিকে সিপিবির ২০১৫র প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশে চাকরীরত ভারতীয়র সংখ্যা ৫ লক্ষ, যাদের অধিকাংশই এসেছে টুরিস্ট ভিসায়।

গত পাঁচ বছরে সিঙ্গাপুরের নির্মাণ শিল্পে আরো বেশি শ্রমিক কাজ করতে চলেছে। এদিকে ২0১১ সালে যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য একটি গন্তব্য হিসেবে লিবিয়ার স্থান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর পরিবর্তে, লেবানন, জর্ডান এবং মরিশাস ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে বাংলাদেশে মহিলা অভিবাসীদের জন্য, যারা গৃহকর্মী বা ক্লিনার হিসেবে যাচ্ছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের পাশাপাশি এই তিনটি দেশ মহিলা শ্রম অভিবাসনের ভিত্তিতে বিদেশি শ্রমশক্তিতে নারীর অংশ ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৫ সালে মাত্র এক শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে ।

কেমন এই গমনপথ?:
শ্রমিক ভিসায় বহিরাগতদের ভেতর যারা “অভিবাসী কর্মী নিয়োগ সংস্থা”গুলির মাধ্যমে না গিয়ে দালালের মাধ্যমে যান, তাদের প্রায় সবাই ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি দেয়। গত ১৬ই মে দৈনিকে প্রকাশ, ভাগ্য বদলাতেই অনেকে দেশ-বিদেশি মানব পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছেন। বিপজ্জনক পথে মানব পাচারের ভয়াবহ পরিণামের সর্বশেষ উদাহরণ লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশের লোকজনের নৌকাডুবির ঘটনা। তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নিহতদের তালিকায় ৩৯ বাংলাদেশির পরিচয় পাওয়া গেছে।

মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু দালালকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের একটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে লিবিয়া আর তুরস্কে, যেই পিশাচেরা শুধু এই স্বপনচারী হতভাগ্যদের বিদেশে নেবার ব্যবস্থা বাবদ অযৌক্তিক বিপুল অংক হাতিয়েই ক্ষান্ত হয় না, মধ্যপথে বন্দি করে বন্দুক ঠেকিয়ে দেশে ভিডিও কল করে পরিজনের কাছ থেকে আরো মোটা অংক আদায় করে। এই ঘটনায় অনেকেই গ্রেফতারও হয়েছে। এদের চরম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না হলে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই।

গেল বছর অক্টোবরেও মেক্সিকোর দুর্গম পথে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি আটক হন। তাঁদের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে আটক করা হয় ১৯২ জন বাংলাদেশিকে। তাঁদের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথটি হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ । ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওই পথ দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় প্রতি ৫০ জনের ১ জন মারা গেছে। আর এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অন্তত ১৭ হাজার অবৈধ অভিবাসী ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে ঢুকে পড়েছে। এ সময়ে সাগরে হারিয়ে গেছে অন্তত ৪৪৩ জন।

অন্যদিকে উপসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণমূলক শ্রম শর্তাবলীর কারণে প্রায়শই তারা অমানবিক শ্রম এবং কর্মস্থলে অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হন। অভিবাসীদের ভিসা এবং কর্মক্ষেত্রের পারমিটগুলির পাশাপাশি ভ্রমণের অগ্রিম প্রক্রিয়াকরণের খরচ বহন করতে হবে।

বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত বা শ্রীলংকার শ্রমিকদের চুক্তিগুলি প্রায়শই সাময়িক নিয়োগ চুক্তি এবং শোষণমূলক হয়। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা মান খুব কম, যার ফলে অসুস্থতা, নির্যাতনের ঘটনায় ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ থেকে ৬০০ অভিবাসী কর্মী বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। তথাকথিত কাফালা পদ্ধতিতে, অভিবাসী শ্রমিকরা সহজেই একটি চাকরি ছেড়ে যেতে পারে না এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বা স্পন্সর বা চুক্তি পরিবর্তন করতে পারেনা ।

এতদসত্ত্বেও উপসাগরীয় অঞ্চলে তারা যে আয় উপার্জন করতে পারে তা দেশে অবস্থানকালীন উপার্জনের তুলনায় অনেক বেশি। ২০১৮ এর বিশ্বের অধিবাসী সংক্রান্ত রিপোর্টে পৃথিবীর সর্বাধিক অভিবাসী ভারতীয় হলেও ১৪০ কোটির দেশ ভারতের অভিবাসী ১.৫৬ কোটি, সেখানে আমাদের ১৮ কোটির দেশে অভিবাসী এখন প্রায় ১ কোটি ( ৫ম শীর্ষস্থানীয়)।

তবে সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে হয়েছে ২১ শতাংশ। অথচ বেকারত্বের হার কমবেশি একই রকম থেকে গেছে। পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না অন্তত ৬৬ লাখ নারী-পুরুষ।

দেশের উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির এমন আবহে বাংলাদেশি নাগরিকদের মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ার কারণ প্রশ্নে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন , ‘মরিয়া হয়ে যাঁরা বিদেশ যাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ।

...অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি হয়তো চায়ের দোকানে কিংবা অ্যাপভিত্তিক পরিবহন যাত্রীসেবায় লোকজনের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে। কিন্তু বিদেশগামী তরুণেরা আসলে কী ধরনের কাজ চান, সেটা আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।।...”

পরিশেষে:
সম্প্রতি জাপান সফরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকার ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার জন্য বিদেশে চাকরি প্রার্থীরা সেখান থেকে ঋণ নিতে পারেন। সরকার সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ অনেকগুলো চাকরির সুযোগ সৃষ্টিকারী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তাছাড়া সরকার দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে।

এমতাবস্থায় এই মানবপাচার কি অনন্যোপায়, অজ্ঞানতার বলি ? না মূলত পরিশ্রম না করে রাতারাতি বড়লোক হবার বাসনা চরিতার্থ করার জন্য লোভের বলি ? না তাঁরা নিজেদের জন্য নিশ্চিত /উন্নত ভবিষ্যৎ , মর্যাদাসম্পন্ন কাজ চান?

কার কি যোগ্যতায় আমাদের সমাজে প্রাগৈতিহাসিক মানদণ্ডে “মর্যাদাসম্পন্ন” কাজ পেতে পারে কিংবা সেই গ্যারান্টিও কতটুকু প্রতারণা তাও জানার অধিকার তাঁর আছে । নয়তো স্রেফ গমন পথেই ২% মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা বিদেশে যেতে বাধ্য হবে বা বেছে নেবে। প্রবৃদ্ধির হারে তাদের কন্ট্রিবিউশন গণনা হবে, মৃত্যু নয়।
তথ্যসুত্রঃ ১। www.bpb.de/gesellschaft
২।www.bpb.de/gesellschaft
৩।www.pewresearch.org/fact-tank
৪।www.prothomalo.com/bangladesh

এইচআর/জেআইএম

মানবপাচার কি অনন্যোপায়, অজ্ঞানতার বলি ? না মূলত পরিশ্রম না করে রাতারাতি বড়লোক হবার বাসনা চরিতার্থ করার জন্য লোভের বলি ? না তাঁরা নিজেদের জন্য নিশ্চিত /উন্নত ভবিষ্যৎ , মর্যাদাসম্পন্ন কাজ চান?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।