মিজান-মোয়াজ্জেমের বোঝা কেন সরকারের ঘাড়ে?
গা ঢাকা দেয়ার ২০ দিন পর বাঙালকে হাইকোর্ট দেখিয়ে গ্রেফতার হলেন সোনাগাজীর বহুল আলোচিত ওসি মোয়াজ্জেম। এত ক্যারিকেচারে কী অর্জন হলো সরকারের? আলোচনার আরেক পুলিশ তারকা ডিআইজি মিজানের ব্যাপারে ক্ষোভ জানিয়েছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। প্রশ্ন ছুড়ে বলেছে, ডিআইজি মিজান কি দুদকের চেয়েও ক্ষমতাশালী?
কিছু সদস্যদের কাণ্ড-কীর্তিতে গোটা পুলিশ বাহিনীর ইমেজই প্রশ্নবিদ্ধ। ডিআইজি মিজান বা ওসি মোয়াজ্জেম ধাঁচের সদস্যদের কারণে ইয়ার্কি-মশকরাও হচ্ছে পুলিশ নিয়ে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে সরকারও। তা মোকাবিলায় নানান বুঝ দিতে হচ্ছে গণমাধ্যমসহ মানুষকে। কিন্তু, মানুষ কি এসব বুঝ মানছে? পথে-ঘাটে বলাবলি হচ্ছে: মিজান-মোয়াজ্জেমদের দায় কেন নিচ্ছে সরকার? কী ঠেকা লেগেছে? কোন দায় পড়েছে?
পুলিশের সৎ-পেশাদার সাবেক-বর্তমানদের কাছেও বিষয়টি বিব্রতকর। দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহারসহ পুলিশের নানা অপকর্মের খবর তাদের বেদনাহত করে। নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিতে লজ্জা পান। কারো সামনে পড়লে লজ্জিত হন তারা। ছি ছি করেন নিজেরাও। ধর্ষণ, ছিনতাই, মানুষের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, লাশবাহী গাড়ি থেকেও পুলিশের চাঁদা তোলার মতো খবরে মুখ ঢাকেন তারা।
পুলিশের সবাই কি এসব করেন? সবাই মিজান-মোয়াজ্জেম? না। মোটেই না। কেন পুলিশের প্রশংসা করার মতো অর্জনগুলো চলে যাচ্ছে বিসর্জনের খাতায়? তা গুণধর কিছু মিজান-মোয়াজ্জেম কিছিমের সদস্যদের কারণে। মিজান-মোয়াজ্জেমের চেয়ে সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী শবনম- পারভেজের তালিকা বেশ দীর্ঘ। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার বাসের যাত্রীদের প্রাণরক্ষায় পুলিশ কনস্টেবল পারভেজের নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পথচারীর পায়ের শুশ্রূষায় সাব ইন্সপেক্টর শবনমের দায়িত্ব পালনের খবরও মানুষ দেখেছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে বাচ্চার জন্য দুধ চুরি করা বাবাকে জেলে না নিয়ে চাকরি দিয়ে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী জাহিদও একজন পুলিশ কর্মকর্তা-এএসপি।
নানা ঘটনা ও কর্মকাণ্ডে সমাজে পুলিশকে মানুষের বদলে মন্দ কিছু মনে করার একটি প্রচলন রয়েছে। পুলিশের দুর্নীতি-অপকর্ম ব্যাপকভাবে আলোচিত। সাদা চোখেও এ বাহিনীটির অনেক কিছু দেখা যায়। জনসম্পৃক্ত বাহিনী হওয়ায় তাদের খামচিটা মানুষ ভোগে সরাসরি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অনৈতিকতায় মানুষ এভাবে সরাসরি আক্রান্ত হয় না। এরপরও এখন পর্যন্ত নিরাপত্তার প্রশ্নে মানুষের অন্যতম আশ্রয়স্থল পুলিশ।
মধ্যরাতে বাসায় বা আশপাশে কোনো ঝামেলা হলে মানুষ পুলিশের দ্বারস্থই হয়। অন্য কারো পুলিশের মতো এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় না। তা করতে গিয়ে বাহিনীটির অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে। নিয়মিতভাবে পেট্রোলিংয়ের বাইরে স্বজন-পরিজন ছেড়ে ভিআইপি-ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতে হয়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় থাকতে হয় নন-স্টপ ডিউটিতে। ঈদ, পূজা, নববর্ষের মতো দিনগুলোতে ছুটিছাটা বাতিল। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা অঘটনে বাধ্যতামূলক বাড়তি ডিউটি।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে আমাদের পুলিশ বাহিনী। ইন্টারপোল, সার্কপোল ইত্যাদি সংস্থাতেও বেশ সুনাম। সেই সুনামের পরিণতি কেন দুর্নামে? মূল্যায়ন প্রশ্নে পুলিশ কেন অপাঙ্ক্তেয়? গণহারে সমালোচিত? কেন শবনম-পারভেজদের চেয়ে মিজান-মোয়াজ্জেমরা বেশি শিরোনাম? মানুষের সবচে’ কাছাকাছি বাহিনী পুলিশ। তাদের দুর্নীতি অনেকাংশেই প্রত্যক্ষ। মানুষ সরাসরি দেখে। পুলিশের প্রতি গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরও সার্বক্ষণিক।
আবার সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নও বেশি হয় পুলিশের মাধ্যমে। সমালোচনা করতে গিয়ে পুলিশের দরকার আছে কি-না, এমন প্রশ্নও তীরের মতো ছোড়া হয়। বলার চেষ্টা করা হয় পুলিশ থাকাতেই দেশে এত অপরাধ। মোটকথা পুলিশমুক্ত রাষ্ট্রকামনা। পুলিশ না থাকলে কোন অপরাধ হবে না- এমন আক্রমণাত্মক ভাবের প্রকাশ ঘটছে। এর পেছনে প্রেক্ষিত রয়েছে। নেপথ্যে রয়েছে গভীর কোনো বেদনা, ক্ষত বা অভিজ্ঞতা। কিন্তু, আদতে পুলিশহীন রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না।
মানব সভ্যতার ইতিহাস এমন ভাবনা সমর্থন করে না। প্রাচুর্যশীল বা দারিদ্র্য-জর্জরিত, গণতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক কোন সমাজই পুলিশ ছাড়া চলতে পারে না। সভ্যতার ইতিহাস বলছে, পুলিশ ছাড়া কোন সমাজ ছিল না। এখনও নয়। যেখানে আইনের অস্তিত্ব ছিল, সেখানেই পুলিশি কার্যক্রম ছিল। যেখানে আইন থাকবে, সেখানে পুলিশি কার্যক্রম থাকবেই। সমাজ তার দরকারেই দলগতভাবে পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বা নিয়মিত পুলিশ সংগঠন তৈরি করেছে। একটু কি ভাবা যায় মাত্র একটি ঘন্টা পুলিশ না থাকলে দেশের কি অবস্থা হতে পারে? বাংলাদেশের সকল পুলিশকে এক মাসের ছুটিতে পাঠালেই বা কী দশা দাঁড়াতে পারে? কোন পর্যায়ে ঠেকবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি?
পৃথিবীতে পুলিশই একমাত্র সরকারি সেবাদানকারী সংস্থা যার সেবা নিঃশর্তভাবে দিবারাত্র ২৪ ঘণ্টা পাওয়া যায়। ব্যতিক্রম হিসেবে কিছু দেশে পুলিশ সংগঠন রীতিমতো ধর্মঘট করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বা এখনও করে। আর পুলিশ যে সমাজের জন্য কতটা অপরিহার্য, তা বোঝা যায়, পুলিশ যখন ধর্মঘট বা কর্মবিরতি শুরু করে। তখন মালুম হয় পুলিশ সমাজের অক্সিজেনের মতো। বাতাস থেকে অক্সিজেন সরিয়ে নিলে যেন বোঝা যায় অক্সিজেন ছাড়া মনুষ্য জীবন অচল।
খ্রীস্টপূর্ব ২০৫০ অব্দে সুমেরীয় শাসক উর-নামু সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রচলিত আইনের একটি সংকলন প্রকাশ করেন যা বিখ্যাত হাম্মুরাবীর কোড নামে পরিচিত। হাম্মুরাবীর আইন কার্যকরে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম পুলিশ সংগঠনের সৃষ্টি বলে গবেষকরা একমত। ভারতীয় সভ্যতায় মনু সংহিতাই ছিল সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক আইন। এই আইন প্রয়োগের জন্য বিধিবদ্ধ পুলিশ না থাকলেও তৎকালীন শাসকরা নানাভাবে পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
প্রাচীন যুগে গ্রামাঞ্চলের জন্য স্থানিক ও শহরের জন্য নাগরিক নামের দুই শ্রেণির কর্মকর্তার সন্ধান পাওয়া যায় যারা সাধারণ শাসনকার্যসহ পুলিশি কার্যক্রমও পরিচালনা করতেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে তৎকালীন শাসকরা বেশি গুরুত্ব দিতেন গোয়েন্দা কর্মকে। এই ধরনের পুলিশিং ব্যবস্থা মধ্যযুগে মুসলিম আগমনের আগ পর্যন্ত চালু ছিল। মুসলিম সুলতানরা মুহতাসিব নামে একজন প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করেছিলেন। মুহতাসিবের অধীনে বড় বড় শহরের জন্য কোতওয়াল মোতায়েন করা হয়। আর মফস্বল শহরের জন্য তৈরি করা হয় ফৌজদার। গ্রামে ফৌজদারের অধীনে টহলের জন্য থাকতো ঘোড়সওয়ার কনস্টেবল। পরবর্তী নিচের পর্যায়ে রাখা হয় থানাদার, চৌকিদার ইত্যাদি।
ইংরেজরা ১৭৫৭ সালে ভারত দখলের পর মুসলিম শাসকদের পুলিশি ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন অক্ষুণ্ন রাখে। পরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের পুলিশিংকে তাদের মতো করে সাজানো শুরু করে। ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান পুলিশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে সেই পুলিশি ব্যবস্থাই চলছে। এরমাঝেই পুলিশে ভিন্নতা যোগ হয় একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাক সামরিক জান্তার প্রথম বুলেট পড়েছিল পুলিশের বুকে। জঘন্য সেই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের প্রথম টার্গেট ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্। তাৎক্ষণিক ওই সংবাদে পূর্ববাংলার প্রায় সকল পুলিশ লাইন্সেই প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয় রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ বড় বড় পুলিশ লাইনসে। মাস্টাররোল এবং মুজিবনগর সরকারের দলিলপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার কর্মস্থল ছেড়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ১১০০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য। অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেলের প্রতিরোধ সূচনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাসের অনবদ্য অংশ। পুলিশও তার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়েছে আরো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মতো ।
পুলিশের ইমেজ প্রতিষ্ঠা বা মর্যাদা রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, জনপ্রিয়তা সব মিলিয়ে অনন্য উচ্চতা রয়েছে তারই। চাইলেই তিনি তা পারেন। সেই হিম্মত আছে তারই। মিজান-মোয়াজ্জেম মার্কা পুলিশরা নিশ্চয়ই নিজামী-মুজাহিদের মতো শক্তিমান নন। আবার সরকারের অ্যাসেটও নন। বরং লায়াবিটিস। এ দায় মোচনের কোনো অ্যাকশন তিনি না নিলে অন্য কারো পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশকে এখনো অনেক কিছু দেয়ার আছে শেখ হাসিনার। বিশেষ করে পুলিশকে কলঙ্কমুক্ত করে একটি গর্বিত বাহিনীতে দাঁড় করানোর নজির তৈরি করতে চাইলে তার পক্ষেই অবশ্যই সম্ভব। এ কাজ তিনি নিজ হাতেই করবেন এমন নয়। তা করাতে পারেন সৎ, দক্ষ, বিশ্বস্তদের দিয়ে। প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী কমিটি করে তিনি এ কাজটির সূচনা করতে পারেন। দেশপ্রেম, কমিটমেন্ট, সততায় পরীক্ষিতজনদের সমন্বয়ে এমন উদ্যোগ নিলে সাফল্য না এসে পারে না। পুলিশকে শতভাগ দুর্নীতি-অনিয়মমুক্ত করা না গেলেও অবশ্যই লাগাম টানতে পারবে এমন উদ্যোগ।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর