নিরীহ বেচারা সত্যাগ্রহী রাহুল

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:৪১ পিএম, ৩০ মে ২০১৯

কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে প্রথম ক্ষমতা হারায়। কংগ্রেসের ভয়াবহ ভোট বিপর্যয়ের আগে-পরে জহর কোট আর গান্ধী টুপি পরা কংগ্রেস কর্মী দেখলে সাধারণ মানুষও বিদ্রুপ করতো। সেবার ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্চয় গান্ধী রায় বেরেলী এবং আমেথিতে পরাজিত হলেও দক্ষিণ ভারত কংগ্রেসকে বিমুখ করেনি। কংগ্রেস সেই সময়ও দক্ষিণ ভারতে ৭৯টি আসনে জিতে ছিল। কিন্তু গত ২০১৪ সালের ষষ্টদশ লোকসভা নির্বাচনে আর এবারের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আসন পেল ৪৪টি আর ৫১টি।

কংগ্রেসের বয়স এখন ১৩৪ বছর। এ উপমহাদেশে প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ প্রাণী জগতের এ নিষ্ঠুর সত্যটি কি নিষ্প্রাণ রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসের জন্যও প্রযোজ্য হবে? রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি। তিনি গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহীদের মতো মানুষ। তিনি কি এ শতাব্দীর কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কংগ্রেসকে তার দাদী ইন্দিরা গান্ধীর মতো নবজীবন দান করতে পারবেন নাকি মা সোনিয়া গান্ধীর মতো নেতৃত্ব ছেড়ে কংগ্রেসকে বাঁচাবেন- এটিই এখন আলোচনা ভারতজুড়ে?

কংগ্রেসের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটি- ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রাহুল গান্ধী দলের পরাজয়ের দায় নিয়ে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন। বরং তার উপরই দায়িত্ব দিয়েছে দলকে ঢেলে সাজানোর। তবে পরবর্তী যত খবর বেরুচ্ছে মনে হচ্ছে এখনও রাহুল গান্ধী ইস্তফা দেওয়ার ব্যাপারে অনড় রয়েছেন। তার মা সোনিয়া গান্ধী আর বোন প্রিয়াঙ্কা ভাদরা অবশ্য রাহুলের ওপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিয়েছেন।

তিনি যে ইস্তফা দিতে পারেন, এই কথাটা ভোট গণনার দিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। রাহুল ভাল বক্তৃতা দিতে পারেন না, ঠিকমত হিন্দি বলতে পারে না, মোদির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন সেটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারেননি- এমন নানাসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বেচারা রাহুল সবই মাথা পেতে নিয়েছেন। রাহুলের দুর্বলতাই কী কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আসতে দিচ্ছে না নাকি মোদির রসায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না কংগ্রেস।

মোদির রসায়নের পাশে রাহুলদের জেতা কেন কঠিন হয়ে গেছে একনজরে দেখা যাক। প্রধানত কংগ্রেসসহ বিরোধিরা মোদির বিরুদ্ধে একজোট হলেও তাদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী কে ভোটারদের কাছে তা পরিষ্কার ছিল না। আবার মোদির বিকল্প যে নামটি এই ক্ষেত্রে সামনে এসেছে সেটিও রাহুল গান্ধীই। কিন্তু ভোটাররা তাকে মোদির বিকল্প হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। এবারের ভোটটিই হয়েছে প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাইলে। মোদি ছিল সামনে। ভোটাররা তাদের এমপিকে ভোট দেয়নি, যেন দিয়েছে মোদিকে। সে কারণেই এবারের এমপিদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ক্রিমিনাল মামলায় অভিযুক্ত, যার মধ্যে আবার ২৯ শতাংশের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হত্যার মত মামলাও রয়েছে। এর আগের দুই সংসদে ক্রিমিনাল কেস খাওয়া এমপির পরিমাণ ছিল ৩০% (২০০৯) এবং ৩৪ % (২০১৪)।

মোদি বিরোধিরা তার বিরুদ্ধে শুধু ক্যাম্পেইন-ই করেছে কিন্তু বিকল্প হিসেবে তারা কি দিতে যাচ্ছে সেটা পরিষ্কার ছিল না। নিজেদের ক্যাম্পেইনেও বিরোধিরা ছিল অনেক পেছনে। জোটে কে থাকছে কে থাকছে না এটা ভোটের শেষ পর্যায়েও জল্পনা কল্পনা চলেছে। অভিযোগ করেছে একে অন্যকে, মোদি বিরোধী ভোট কাটাকাটি নিয়ে। মোদির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়ায় যেমন রাহুল গান্ধী পাত্তা পাননি, তিনি নিজেও দূরে ছিলেন তাদের থেকে। শেষ বেলায় মিডিয়ার সঙ্গে দুই একটা সাক্ষাৎকার দিলেও তখন অনেক দেরি।

কংগ্রেসের জন্য এবার প্রেরণা হিসেবে এসেছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। কিন্তু আসবেনই যখন তখন এতো দেরিতে কেন!

সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার কর্মী বসিয়ে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা আর বিরোধিদের বিরুদ্ধে ভুয়া সংবাদ প্রচার করেছে বিজেপির বেতনভুক্ত কর্মীরা। কংগ্রেসসহ বিরোধীরা সেটা পারেনি, বিজেপির তুলনায় তাদের অর্থের পরিমাণও আকাশ পাতাল ছিল ক্যাম্পেইন বাজেটের ক্ষেত্রে।

পুলওয়ামা হামলাকে দিয়ে পাকিস্তান বিদ্বেষ, সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে ভারতের জন্য হুমকি এবং নন-বিজেপি পুরো গোষ্ঠিকে এন্টি ন্যাশনালিস্ট বানিয়ে নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী এবং মোদির হাতে ভারত নিরাপদ এই ভাবনা ভোটারদের মনে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল বিজেপি।

লক্ষ্য করুন, নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তার কিছুই বাস্তবে পরিণত করতে পারেননি। দুনিয়ার নাম করা ম্যাগাজিনগুলো ৫ বছরের খতিয়ান দিয়ে তার ব্যর্থতার প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। রাফায়েল কেলেঙ্কারী সামনে এসেছে। ভারতের বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান হার, অর্থনীতির দুরবস্থা,ধর্মীয় উত্তেজনা, সীমান্ত-সংঘাত এবং রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতাসহ একটা সরকার পরাজিত হওয়ার জন্য যতগুলো লক্ষণ থাকার প্রয়োজন সবগুলোই ছিলো তবু নির্বাচনে মোদি পরাজিত হলেন না বরঞ্চ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জিতে ছিলো ২৮২ আসন পেয়ে আর ২০১৯ সারের সপ্তদশ লোকসভায় জিতলো ৩০৩ আসন পেয়ে।

বিরোধী দলগুলো ভোট গ্রহণে কোনও দুর্নীতি হয়েছে এমন কোনও অভিযোগও উত্থাপন করলেন না। অবশ্য বহুজন সমাজ পার্টির মায়াবতী, তৃণমূলের মমতা ইভিএম এ কারচুপি হয়েছে বলে একটুখানি বলতে চেয়েছেন। অভিযোগ তুলেছেন।

উত্তর প্রদেশে বিরোধিদের ফালাফল বিপর্যয় কেদ্রে ভরাডুবির একটি বড় ভূমিকা রেখেছে বিরোধীদের জন্য। বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি আর রাষ্ট্রীয় লোকদল রাহুলকে অর্থাৎ কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোট করে তারা মনে করেছিলো হয়ত বা তারা নিজেরাই উত্তর প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করবে। সুতরাং রাহুলকে ভাগ দিয়ে লাভ কি! পরে সরকার গঠনের সময় শক্তি দেখাতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল হরিজন আর যাদবদের ঐক্যে যেখানে উত্তর প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তাদের পাওয়া উচিৎ ছিলো সেখানে সে পরিমাণ আসন তারা পেল না।

উত্তর প্রদেশে মায়াবতী আর যাদবের উত্থানের কারণে হরিজন আর নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভোট ব্যাংক হারিয়েছে কংগ্রেস। আবার ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় কেন্দ্রে কংগ্রেসের নরসীমা রাও এর সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। ফয়জাবাদে সামরিক বাহিনী থাকার পরও মসজিদ রক্ষায় সেনা বাহিনীকে যেতে বলা হলো না ইত্যাদি কারণে আবার ভোট ব্যাংক মুসলিমদেরকেও কংগ্রেস হারিয়েছে। উত্তর প্রদেশে মুসলমানের সংখ্যা ১৮ শতাংশ। সুতরাং যে প্রদেশে কংগ্রেসকে সব সময় শক্তি যুগিয়েছে সেখানে কংগ্রেস বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে।

রাহুলের পক্ষে এ অবস্থা স্বল্প সময়ের মধ্যে ঠিক করা কঠিন তো হবেই। সর্বোপরি কয়েকটা মর্যাদাবোধ সম্পন্ন মিডিয়া ছাড়া সব মিডিয়াই নরেন্দ্র মোদির খপ্পরে পড়েছে। পুলওয়ামার ঘটনাকে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া নির্বাচনের সময় এমন এক মনগড়া প্রচারণা চালায় যে তাতে তারা নরেন্দ্র মোদিকে ছত্রপতি শিবাজীর সাথে তুলনা করে তার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার বয়ান লিখে প্রচার করে। অথচ পাকিস্তান বালাকোটের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পাল্টা স্ট্রাইক চালালে ভারত তা প্রতিহত করতে এসে দুটি যুদ্ধ বিমান হারিয়েছ আর একজন পাইলট পাকিস্তানের হাতে বন্দী হয়েছে।

ভারতের নব্বই কোটি ভোটারকে অর্থ আর মিডিয়া অসহায় করে ফেলেছে সেখানে রাহুলের মতো একজন নিরীহ সত্যাগ্রহী কি আর করতে পারেন! রাহুল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বলছেন তিনি আর কংগ্রেসের সভাপতি পদে থাকবেন না। পরিবারতন্ত্রের বাক্যবান থেকে তিনি পরিত্রাণ চাচ্ছেন। তাকে পরিত্রাণ দেওয়া উচিৎ। তিনি তো সংসদীয় গ্রুপের নেতা থাকতে পারবেন। গান্ধী পরিবারের বাইর থেকে একজন সভাপতি নির্বাচিত করে দেখতে আপত্তি কোথায়। যাকে আনা হবে তিনি যেন ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

অনেকে বলছেন গান্ধী পরিবারের কেউ হাল না ধরলে কংগ্রেসের ঐক্য ধরে রাখা যাবে না। আমি বলি যে ঐক্য দলকে ক্ষমতায় আনতে পারে না সে ঐক্য থাকা না থাকাতো সমানই। দলকে পরিবারতন্ত্রের বদনাম থেকে বের করে আনা উচিত। রাহুল কংগ্রেসের শীর্ষে নেতৃত্বে না থাকাই ভাল। তাকে দিয়ে আর কত পরীক্ষা হবে! ১৫ বছরতো হলো।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

অনেকে বলছেন গান্ধী পরিবারের কেউ হাল না ধরলে কংগ্রেসের ঐক্য ধরে রাখা যাবে না। আমি বলি যে ঐক্য দলকে ক্ষমতায় আনতে পারে না সে ঐক্য থাকা না থাকাতো সমানই। দলকে পরিবারতন্ত্রের বদনাম থেকে বের করে আনা উচিত। রাহুল কংগ্রেসের শীর্ষে নেতৃত্বে না থাকাই ভাল। তাকে দিয়ে আর কত পরীক্ষা হবে!

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।