সকাল-সন্ধ্যার পর মধ্যরাতের হুইলারোহী এরশাদ

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ০৮ মে ২০১৯

সকাল-সন্ধ্যা নাটক কাটিয়ে এরশাদ নিশিপর্বে। মধ্যরাতের অশ্বারোহী নন, হুইলারোহী। এরপরও এরশাদ এরশাদই। নিজের তুলনা নিজেই। শনিবার মধ্যরাতে হুইল চেয়ারে এসে মিনিট কয়েকের ফটোসেশনে দলে ঘটিয়ে দিলেন নতুন ঘটনা। ছোট ভাই জি এম কাদেরকে আবারও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে দলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেন নতুন ফরমেটে। ভাই তার উত্তরসূরি হিসেবে দলের নেতৃত্ব দেবেন বলে পুরনো ঘোষণা নতুন করে দেন এরশাদ।

চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার আগে গত পহেলা জানুয়ারি জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান করার পাশাপাশি নিজের উত্তরসূরি হিসেবেও ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর গত ২১ মার্চ আকস্মিকভাবেই তিনি কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেন।

এমনকি সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার পদ থেকেও সরিয়ে এরশাদ তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে সেই পদে বসিয়েছিলেন। এর ক’দিন পরই ৪ এপ্রিল তিনি জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান পদে ফিরিয়ে আনেন। শনিবার মধ্যরাতে আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে কাদেরকে দলের গদিনশীল করেন।

একেক সময় একেক কথা ও সিদ্ধান্ত এরশাদের বৈশিষ্ট্য। সময়ে সময়ে এতে কিছু নেতা নাখোশ হলেও এক সময় তারাও এরশাদের এ বৈশিষ্ট্যের সুবাদে লাভবান হন। তখন তারা এরশাদের একেক কথা ও সিদ্ধান্তকে দোষ বলেন না। একে এরশাদের মহানুভবতা-উদারতা হিসেবে কবুলই করেন না, প্রশংসাও করেন। আর আক্রান্ত হলে বা ভাগে কম পড়লে গোস্যা হন। আদতে জাপার নেতাদের মধ্যেও এরশাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য বেশ প্রভাবিত-সংক্রামিত।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে এরশাদের বার বার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জেরে পার্টি বিভিন্ন সময় বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়লেও এ নেতারা নিজেদের কল্যাণে আশাহত হন না। প্রাপ্তির আশাই করেন। এরশাদের স্বাদ অন্য কিছুতে নেই। বাতকে বাত তাকে নিয়ে বহু কথাই বলা হয়।

স্বৈরাচার-দুরাচারসহ হেন মন্দ মন্তব্য নেই যা তাকে নিয়ে করা হয় না। সবই হজম করছেন। সয়ে যাচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে, ‘এরশাদ যার বন্ধু, তার আর শত্রুর দরকার হয় না।’ কিন্তু বাস্তবে এই শত্রুকে কাছে পেতে প্রতিদ্বন্দ্বির অভাব নেই। এরশাদ যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন সার্কাসের কোন দরকার পড়বে না- এমন তীর্যক মন্তব্য নিক্ষেপকারীদেরও দেখা যায় তার কৃপা নিয়ে সার্কাসের জোকার হতে।

তবে, এবারের প্রেক্ষিতটা কিঞ্চিত ভিন্ন। দীর্ঘদিন পর সেই রাতে হুইল চেয়ারে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে তাকে গুরুতর অসুস্থ দেখাচ্ছিল। কথাই বলতে পারছিলেন না তিনি। ফলে তিনি অবসরে যাচ্ছেন কিনা- সেই প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন জি এম কাদের। বলেছেন, এরশাদ ৯০ বছর পার করেছেন। আর এখন তিনি সত্যি সত্যি অসুস্থ। শরীরটা খুব খারাপ। তবে উনি যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন উনিই চেয়ারম্যান। তার কথার বাইরে কিছু হবে না।

এরপরও কেন এতো রাতে সিদ্ধান্তটা জানাতে হলো, চুপকি-চুপকি ডাকা হলো সাংবাদিকদের? এরশাদের অবর্তমানে জিএম কাদের পার্টির দায়িত্ব পালন করবেন- এটা নির্ধারিতই ছিল। এরপরও নেপথ্যে কি আরো কিছু ছিল? কোনো উদ্দেশ্য-বিধেয়, সাবজেক্ট-অবজেক্ট ছাড়া এরশাদ একটা নিঃশ্বাসও ফেলেন না। এ বৈশিষ্ট্যের গুণেই পতিত স্বৈরশাসক হয়েও তিনি সরকারের খাস পছন্দের লোক। রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদেরের মধ্যে বিরোধ সবারই জানা। এরশাদ দু’দিকেই থাকেন। আছেন। নেতাকর্মীদের সুচতুররাও ঝোপ বুঝে কোপ মারেন দু’দিকেই। সকাল-সন্ধ্যা যাতায়াত রাখেন দেবর-ভাবির কাছে।

এবারের নির্বাচনের আগেও সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন এরশাদ। এর আগে ভর্তি হয়েছিলেন সিএমএইচে। নির্বাচন এলেই এরশাদকে সিএমএইচে যেতে হয়। কখনো স্বেচ্ছায়। কখনো বাধ্য হয়ে। এমন ইলেকশন সিনড্রোমের মধ্যেও সিএমএইচে থাকা অবস্থায়ই এরশাদ দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনেন। রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে বসান মসিউর রহমানকে।

এরশাদের জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি করা যে দলীয় চেয়ারম্যান চাইলে যেকোনো সময় যে কাউকে বাদ দিতে পারেন। যে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এভাবে চেয়ারম্যান চাইলে যে কেউ দলের নেতা হতে পারেন। আবার তিনি বাদও দিয়ে থাকেন। ভাই জিএম কাদের, এমন কি স্ত্রী রওশনকেও একাধিকবার তিনি বাদ দিয়েছেন। আবার পদ-পদবি দিয়েছেন। তারাও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এ সার্কাসে।

এবারের নির্বাচনে নিজের আসনটি নিয়ে সার্কাস করতেও ছাড়েননি এরশাদ। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে এরশাদ জাতীয় পার্টিকে মহাজোট কতটি আসন দিয়েছে, সেটি খোলাসা করেননি। প্রথমে জাতীয় পার্টির নেতারা বললেন, তাঁরা মহাজোটের কাছে ১০০ আসন চাইবেন। অন্তত ৬০টি দিলে রাজি হবেন। দর-কষাকষির মাধ্যম হিসেবে তাঁরা ১৪৭টি আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী দিয়ে রাখলেন; যার মধ্যে ঢাকা -১৭ আসনে এরশাদের নিজের প্রার্থিতাও ছিল। কিন্তু দর–কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সুবিধা করতে পারেনি।

আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৫টির বেশ আসন ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। আবার লাঙ্গলের বেশ কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থেকে যান। ঢাকায় ফিরে এরশাদ নিজের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, ‘বোন’ শেখ হাসিনাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ঢাকা-১৭ আসন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকবর হোসেন পাঠান ওরফে নায়ক ফারুককে সমর্থনের কথাও জানান। বললেন, ‘ফারুক আমার কাছে এসেছিল। আমি তাঁকে বললাম, টাকা এনেছ। সে বলল, টাকা তো নেই। তখন আমি বললাম, টাকা লাগবে না। আমি আসনটি তোমাকে ছেড়ে দিলাম।’

বাংলাদেশে ৩৫ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। সেদিন ঢাকায় শিক্ষাভবন অভিমুখে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। সেই আন্দোলন কালক্রমে গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল এবং জেনারেল এরশাদের শাসনের পতন হয়েছিল নব্বইয়ের শেষে। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে পতন হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন জেনারেল এরশাদ। সেটা সম্ভব হওয়ার পেছনে বিশেষভাবে কাজ করেছে তার সকাল-সন্ধ্যা কৌশল। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির দেউলিয়াত্বের সুযোগটা তিনি নিয়েছেন ষোলআনা। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে সাতদল এবং এর বাইরে অন্যান্য দলের যুগপৎ সেই ভূমিকাও এখন শুধুই ইতিহাস।

দুদলকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলিয়ে এরশাদ দিব্যি সুবিধা নিতে পারঙ্গমের প্রমাণ দিয়েছেন। প্রধান দুই দলের বিভেদের রাজনীতির সুযোগ নিয়ে এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। ক্ষমতা ছাড়ার পর টিকে থাকার নেপথ্য রহস্যও সেখানেই। নববইয়ের শেষবেলায় জেনারেল এরশাদের পতনের সাথে সাথেই ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের উচ্ছ্বাস ইতিহাসের ছিন্নভিন্ন অংশ মাত্র। সেই প্রেক্ষাপট ভাবলে বিস্মিত-হতবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু থাকে না।

সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ এরশাদকে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছিল বলে দলটির বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে। পরে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা মহাজোট করেছিল। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও অনেক নাটকীয়তার পর শেষপর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে সাথে রাখতে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগ। যার বেনিফিট হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পর খাসপছন্দের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রয়েই গেছেন এরশাদ।

বিএনপির দায়ও কি কম? এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ভূমিকার জন্য তাঁকে আপোসহীন নেত্রী হিসেবে তুলে ধরেন তাঁর দলের নেতা কর্মীরা। এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপিই ক্ষমতায় এসেছিল। তখন এরশাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১০টির বেশি মামলা হয়েছিল। মাত্র একটি মামলায় সে সময় বিচার শেষ হয়েছিল।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি জেনারেল এরশাদকে নিয়ে চারদলীয় জোটও গঠন করেছিল। এছাড়াও বিএনপি বিভিন্ন সময় জেনারেল এরশাদকে সাথে রাখার চেষ্টা করেছে। দু’দলের কাছে সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের কদর রাজনীতি সচেতন যে কারো কাছেই স্পষ্ট।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

দুদলকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলিয়ে এরশাদ দিব্যি সুবিধা নিতে পারঙ্গমের প্রমাণ দিয়েছেন। প্রধান দুই দলের বিভেদের রাজনীতির সুযোগ নিয়ে এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। ক্ষমতা ছাড়ার পর টিকে থাকার নেপথ্য রহস্যও সেখানেই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।