শরবতের স্বাদ

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

মোস্তফা হোসেইন

শরবতের স্বাদ নেননি ওয়াসার এমডি। কিন্তু জুরাইনের একজন গ্রাহক মিজানুর রহমান ঠিকই শরবতের তেতো ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওয়াসার পানির দুর্গন্ধ কি এখনো কর্তৃপক্ষের নাক স্পর্শ করতে পেরেছে? কী বলে ওয়াসার বক্তব্য।

ওয়াসার এমডি টিআইবির একটি রিপোর্ট এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবেই বলেছেন, ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি শতভাগ সুপেয়। স্পষ্টতই তিনি টিআইবির রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন টিআইবির গবেষণা নিয়ে। গবেষণার শুদ্ধতা নিয়ে বলব না, ওয়াসার এমডি যে ‘সুপেয় পানি’র তথ্য দিলেন তা যে ওয়াসার গ্রাহকদের ঝাঁকুনি দিয়েছে তা বোধ করি তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।

একটা অসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাকে আরো অসত্য বলতে হচ্ছে। এবং অনাকাঙ্খিত কাজও তার প্রতিষ্ঠানকে করতে হচ্ছে। প্রথমত তিনি ওয়াসার এমডি হলেও ঢাকা শহরের অধিবাসী, তিনি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলেও তার প্রতিষ্ঠান থেকেই বিশুদ্ধ পানি বোতলজাত করে বিপণন হয়। শুধু তাই নয় অনুমান করি, ব্যক্তিগতভাবেও তাকে বোতলজাত পানি খেতে হয়। ঢাকা শহরের প্রায় সবার মতো তার বাসায়ও যে পানি ফুটিয়ে খাওয়া হয় সেই অনুমানও মিথ্যা হওয়ার নয়।

এমডি’র বিতর্কিত বক্তব্য প্রচারের পর উচ্চ মহল থেকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাশিত ছিল। মানুষের ক্ষোভ নিরসনে অন্তত আশ্বস্ত হওয়ার মতো বক্তব্য আসুক এটাই স্বাভাবিক ছিল। এক্ষেত্রেও এমডি’র বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেলো। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘সুপেয় পানি’ বিষয়ক বক্তব্যটি সম্পর্কে এমডিই বলতে পারবেন। তবে এই প্রসঙ্গে বাকি বক্তব্যগুলো এমডি’র বক্তব্যকেই সমর্থন করে।

তিনি বলেছেন, ‘সোর্স বা প্ল্যান্ট থেকে পানি দেয়া হয় সেখানকার পানি সুপেয়। আমিও এর সঙ্গে একমত। তবে পাইপলাইনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ির রিজার্ভারে যাওয়ার পর যে পানি উত্তোলন করা হয় সেই পানির বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন, ময়লা পানি শুধু রিজার্ভারের কারণে হয়ে থাকে?

জুরাইনের মিজানুর রহমান বলেছেন, পুরো এলাকাতেই দূষিত পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। যে কারণে তাদেরকে মসজিদের ডিপটিউবওয়েল থেকে পানি কিনে খেতে হয়। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদে দেখা গেলো কিভাবে মসজিদের ডিপটিউবওয়েল থেকে এলাকাবাসী পানি সংগ্রহ করছে। তাহলে কি ওই এলাকার সব রিজার্ভারই ত্রুটিপূর্ণ? নিশ্চয়ই না। তাহলে সরকারি ভাষ্যকে কিভাবে গ্রহণ করবে মানুষ?

ঢাকার পানীয় জলের দুরবস্থা নিয়ে নিত্য সংবাদ প্রকাশ হয়। জুরাইনের মিজানুর রহমান যে পানি নিয়ে এসেছিলেন সেরকম পানি যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেই আছে তাও পত্রিকা পাঠক ও টিভি দর্শকদের জানা। তারপরও সরকারিভাবে বলা হয়, এমন কিছু হয়নি যাতে পানি ইভ্যুালুয়েট করা দরকার হবে।

সরকারিভাবেই বলা হলো, ‘এমন কোনো দূষণের অভিযোগ নেই যে আমরা উদ্বিগ্ন হতে পারি’। এতদিন গণমাধ্যমের সুবাদে ওয়াসার পানির দূষণ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। এখন তো সরাসরি গ্রাহক ওয়াসাকে দেখিয়ে এলো।

মিজানুর রহমান পরিবারসহ ওয়াসায় এসেছেন তাই হয়তো রিজার্ভারের কথা বলাও যেতে পারে। কিন্তু রামপুরা থেকেও এমনি পানিসহ শরবত খাওয়াতে গিয়েছেন মনিরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক।

এই রামপুরা, চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ এলাকার পানি সমস্যা নিয়ে কি নতুন খবর এটি। সংবাদগুলো কি সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ওয়াসার তাগাদা হিসেবে কাজ করতে পারে না? তাহলে ইভ্যুালুয়েশনের জন্য অভিযোগ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন?

ওয়াসা বলছে সম্প্রতি তারা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার অভিযোগ পেয়েছে। তবে প্রায় সবই সমাধান করে দিয়েছে তারা। তাহলে জুরাইন রামপুরার যে লোকগুলো ময়লা পানি নিয়ে গিয়েছিল তাদেরও এই সমাধানের আওতায় আসার কথা ছিল।

টিআইবি বলছে, ঢাকার ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। ফুটিয়ে পানি পান করার এই যে সংখ্যা, এই সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য সরকারেরও অনুপ্রেরণা আছে। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিজ্ঞাপন খাতে। বলা যায় সেই ক্ষেত্রে সরকার অনেকটা সফলও হয়েছে।

সেটা প্রমাণ হয় টিআবির রিপোর্টে। এর প্রমাণের জন্য ওয়াটার পিওরিফাইয়ার মেসিনের বিক্রির তালিকা দেখা যেতে পারে। পত্রিকার পাতায় পিওরিফাইয়ার মেশিনের বিজ্ঞাপন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপণন কর্মসূচি দেখা যেতে পারে। উল্লেখ্য ওয়াসার সাফল্যের (!) সুফলও তাদের ব্যবসায় সাফল্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে।

টিআইবি বলেছে, পানি ফুটিয়ে পান করতে বছরে ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়। প্রকাশিত সংবাদে কিন্তু বিভিন্ন অফিস-আদালতে ও বাসা-বাড়িতে পানি বিশুদ্ধকরণে ব্যবহৃত মেশিনগুলোর জন্য কত টাকা ব্যয় করতে হয়েছে তা বলা হয়নি। বলা হয়নি, ওয়াসা-ও যে পানি বোতলজাত করছে সেই বোতলজাত পানি ক্রয় করতে গিয়ে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে মানুষের। বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক বিক্রয় তথ্য পাওয়া গেলে বোঝা যাবে একমাত্র পানি দূষণের কারণে অর্থনৈতিকভাবে দেশকে কতটা গচ্চা দিতে হচ্ছে।

সরকারিভাবে বলা হচ্ছে- ওয়াসা ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান নয়। তবে ব্যর্থতা যে তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? গত কয়েক বছরে ওয়াসা পানির লাইন পরিবর্তনে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সুপেয় পানি সরবরাহ এবং পানি সরবরাহের পরিমাণ বাড়ানোর। কিন্তু খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া মাটির মসজিদ ঝিলপাড় এলাকায় পানি সরবরাহে অনিয়ম এখন নিত্য ঘটনা। ঝিলপাড় এলাকার বিরাট অংশে এখন পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। মূলত লাইনের ত্রুটির জন্য কিংবা সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে।

এলাকাভিত্তিক তথ্য যদি তারা সংগ্রহ করে সত্যিকারভাবে, তাহলে নিজেদেরই বলতে হবে, তাদের ব্যর্থতার পরিমাণটা কত। আর তারা যদি গণমাধ্যমকে সামান্যতম গুরুত্ব দেয় তাহলেও তারা বুঝতে পারবে, আসলে তারা ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান নাকি সফল?

তবু আশার কথা- এতদিন গণমাধ্যমকে তারা গুরুত্ব না দিলেও গণমাধ্যমেই প্রকাশিত টিআইবির রিপোর্টকে অস্বীকার করার জন্য হলেও সাংবাদিক সম্মেলন করেছে। অন্তত জনসম্মুখে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের শুরুতো হলো। হয়তো আগামীতে তাদের দুর্বলতা কিংবা ব্যর্থতাগুলো দূর করার খতিয়ানও প্রকাশ হবে।

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

এইচআর/জেআইএম

টিআইবি বলেছে, পানি ফুটিয়ে পান করতে বছরে ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়। প্রকাশিত সংবাদে কিন্তু বিভিন্ন অফিস-আদালতে ও বাসা-বাড়িতে পানি বিশুদ্ধকরণে ব্যবহৃত মেশিনগুলোর জন্য কত টাকা ব্যয় করতে হয়েছে তা বলা হয়নি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।