ক্ষম হে মম দীনতা

আবেদ খান
আবেদ খান আবেদ খান , সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ
প্রকাশিত: ০৬:৪১ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৯

বাংলা নতুন বছরের উৎসবে মুখরিত বাঙালি জাতি, নববর্ষের ছোঁয়া দেশের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সামাজিক আচার অনুষ্ঠানেও। রমনার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জাতির বিবেকের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো উদাত্ত আহ্বান- অনাচার এবং নৈতিকতার স্খলনের ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ মানবতার প্রতি চরম অবমাননা।

এই আহ্বানের বার্তা, রাষ্ট্রযন্ত্রের অভয়বাণী এসব সত্ত্বেও আমার মন ভালো নেই। আমার স্নায়ু অবসন্ন হয়ে আসে, বুকের মধ্যে প্রচণ্ড অস্বস্তি এবং একই সঙ্গে অবর্ণনীয় ক্রোধ যেন আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে আগুন ধরায়। কিন্তু কিছু করে উঠতে পারছি না। মনের ভেতরে অঙ্গার কিন্তু আমি দাবানলের মতো বিস্ফোরিত হতে পারছি না। তাই আমার মন ভালো নেই।

আমি যখন কোনো অপাপবিদ্ধ কিশোরীর নীরিহ মুখাবয়ব দেখি তখনই চকিতেই পাপীর বিভৎস মুখ ভেসে ওঠে। আমি যখন আনন্দোচ্ছল তারুণ্যকে দেখি, দেখে যখন উদ্ভাসিত হই, তখন দেখি অতি সন্তর্পণে তাদের পেছনে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কতিপয় চোখ। আমি যখন ভাবি আমাদের এই দেশের নারী পুরুষ শিশু জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জন্য বাংলার আকাশ বাতাস কলুষমুক্ত থাকবে, তখন ভণ্ডরা ধর্মের আলখাল্লা পরে আমাদের চেতনা ও বিশ্বাসকে ব্যবচ্ছেদ করে।

যখন রাফি নামের ওই অদেখা তরুণীকে দেখি, তখন একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ উৎসবের সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে, উৎসবের সমস্ত প্লাবন ও সুর মূর্ছনাকে চাপা দিয়ে, প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তখন আমি বিষণ্ন চিত্তে ভাবি এ কোন অন্ধ গহ্বরে নিপতিত হতে চলেছি আমরা। আমার একাত্তর, আমার সযত্নে লালিত চেতনা, আমার মানবিক বিশ্বাস, এ সবই কি ক্রমান্বয়ে অপসৃত হতে চলেছে। এত সুদীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে আমি- আমরা কি আজ হেরে যেতে বসেছি। এসব প্রশ্ন যখন আমাকে দগ্ধ করে, তখন আমি বিষণ্ন হই এবং বিপন্ন বোধ করি। সমাজের এক দুর্লঙ্ঘ্য কারাগারে যেন আমি অবরুদ্ধ। আর বিবেক বিনাশি জীবদের প্রেত্ম নৃত্য অক্টোপাস বন্ধনে চুরমার করে চলেছে আমার অস্তিত্ব। তাই আমার মন ভালো নেই। এতো শুধু নোয়াখালীর সোনাগাজীর মাদরাসা নয়, বাংলাদেশে যে কোনো ধর্মকাতর প্রত্যন্ত অঞ্চলে, রাজধানী থেকে শুরু করে প্রতিটি নগরে, বন্দরে, জনপদে, রাজপথে, এই একই গল্প, একই কাহিনি, একই অব্যক্ত বেদনার শব্দহীন শব্দ ছটফট করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ জনপদে, ইউরোপের তুষার ধবল গিড়িবর্তে, পাশ্চাত্যের রঙিন উদ্যমতার ভাঁজে ভাঁজে আছে একই চাপ চাপ অন্ধকার।

নুসরাত রাফি, তনু থেকে শুরু করে দিল্লির নির্ভয়া, পাকিস্তানের প্রতীমা, ইরাকের কুলসুম, সিয়েরালিয়নের তিন বছরের শিশু, নাইজেরিয়ার শত শত নিরুদ্দিষ্ট ছাত্রী, আইসিসের দ্বারা নিগৃহীত হাজার হাজার নারী ও শিশু। সবই যেন একই কাহিনির চিত্রনাট্য। একই ইতিহাসের নিরন্তর পুনরাবৃত্তি। কি কি এর উৎস, কোন কেন্দ্র থেকে উৎসারিত এই বিকৃত মানসিকতা। কোথায় এর প্রজনন ক্ষেত্র, কারা এই বিষাক্ত শস্যের নীতিবিবর্জিত কৃষক। খুঁজে দেখা দরকার সব কিছু- চিহ্নিত করা দরকার এবং নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ন্যায়নীতি ও সত্যের অন্বেষণে নিবেদিত শক্তিকে করা দরকার সংঘবদ্ধ।

যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, দৃষ্টি নিক্ষেপ করি ইতিহাসের সেই আদিপর্বে, যখন দানবের প্রতাপ ছিল প্রবল। তাহলে দেখতে পাবো মানব জাতির একটি অনিবার্য অংশকে কি অদ্ভুতভাবে পেশীবলে মানবেতর স্তরে পদাবনত করা হয়েছে। পরিণত করা হয়েছে বিকৃত চরিতার্থ করার পণ্যে। ধর্মের কালো নেকাবে ঢেকে দেয়া হয়েছে সেই অংশকে। কোনো দেবীরূপে, কখনো মাতৃরূপে আবার কখনো ‘নহ মাতা নহ কন্যা সুন্দরী রূপসী’ রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম চিন্তায়। এই হলো হাজার হাজার বছরের লালিত ব্যবস্থার পরিণতি। সমাজচক্রে যেই মুহূর্তে নির্ণিত হলে নারীর অবস্থান, তখন থেকেই এই বিকৃতির সূচনা। তাই আমরা দেখবো, বিজয়ী শক্তি লুট করা সম্পদের মতো প্রতিষ্ঠা করেছে নারীর ওপর অধিকারও। হাজার বছর এভাবেই পুরুষ একাধিপত্য করেছে আর নারী বশ্যতা স্বীকার করে এই পরিস্থিতিকে ললাটের লিখন বা কর্মের বিধান বলে মেনে নিয়েছে। ইতিহাসের পর্যবেক্ষণের কারণে আমরা দেখতে পাবো ট্রয়ের হেলেন মিসরের ক্লিওপেট্রাকে, যারা ছিলেন পুরুষের ভোগ্য পণ্যের রঙ করা পুতুল। কিন্তু এটাই ইতিহাসের একমাত্র পাঠ নয়। ইতিহাসের দৃশ্যপটে আবির্ভাব হয়েছে এমন নারী কণ্ঠস্বরের যিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘রূপকথাকে জানা উচিত রূপকথা হিসেবেই।’ পুরাণ কাহিনিকে শেখা উচিত পুরাণ কাহিনি হিসেবেই। অলৌকিক ঘটনার বর্ণনাকে শেখা উচিত কবির কল্পনার মতো করে। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসকে সত্যি হিসেবে শিক্ষা দেয়ার মতো বিপজ্জনক আর কিছু নেই। একটি শিশুর মন এসবকে গ্রহণ করে সত্যি হিসেবে। আর তার পরবর্তী জীবনে এর মর্মান্তিক প্রয়োগ দেখা যায়।

“মানুষ খুব দ্রুতই অন্ধবিশ্বাসকে সত্য বলে গ্রহণ করে এবং সেটা নিয়েই সে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়...
‘প্রতিটি ধর্মই প্রতারণাপূর্ণ। একজন আত্মসম্মান সম্পন্ন মানুষ কখনোই তা গ্রহণ করতে পারে না।”

এই সমস্ত কথা নির্দ্ধিধায় যিনি উচ্চারণ করেছিলেন তার নাম হাইপাশিয়া। জন্ম সম্ভবত তিনশ’ পঞ্চাশ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন আলেক্সজান্দ্রিয়ার প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক লিয়নের কন্যা। হাইপাশিয়ার রূপ, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের জাদুকরি আকর্ষণের ক্ষমতা এবং একই সঙ্গে স্পষ্ট ভাষণ তাকে পুরোহিত তন্ত্রের প্রতিপক্ষে পরিণত করে। আর সেই পুরোহিত তন্ত্রের প্রতিভূ শিরিল চাইছিলেন হাইপাশিয়াকে হত্যা করতে। পিটার নামের এক খ্রিষ্টানের নেতৃত্বে কালো পোশাকধারী পাঁচশ’ ঘাতক, সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করলো হাইপাশিয়াকে। আমরা নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার সিরাজীয় চক্রান্তের সঙ্গে হাইপাশিয়ার হত্যাকাণ্ডের মিল খুঁজে পাই।

ইতিহাস আরো বলে জোয়ান অব আর্কের কাহিনি। এই সাহসী নারীকে কুসংস্কারবাদীরা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল ডাইনি বলে। ধর্মের নামে ইচ্ছাকৃত ভুল মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে ভারতে শত শত বছর ধরে সতীদাহের ফলে কত হাজার হাজার নারীকে যে প্রাণ দিতে হয়েছে সেই পরিসংখ্যান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রাখে না বা রাখতে চায় না। আমি যখন পৃথিবীর দিকে চোখ রাখি তখন মনে হয় কি গুরুতর অসুখে আক্রান্ত পৃথিবী। প্রবল পরাক্রমশালী নৃপতি যখন অনায়াসে মিথ্যাচার করেও ধরা পরে নির্লজ্জ হাস্যে সবই তুচ্ছ করে এবং লাম্পট্যকে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে পৌরুষ প্রমাণে প্রবৃত্ত হন কিংবা বিশ্বময় যুদ্ধ নিনাদ ছড়িয়ে দেন আর অন্ধ করতালিতে ফেটে পরে স্তাবকের দল।

যখন দেখি হিংস্র ধর্মবিশ্বাসী পশুহত্যা নিরোধের নামে নির্বিকারভাবে মানুষ হত্যা করে কিংবা যখন দেখি বিশ্বের বিভিন্ন উপাসনালয়ে, উপাসনালয়ের অভ্যন্তরে অথবা বাহিরে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র অনায়াসে মৃত্যু উদ্গীরণ করে তখন বিষণ্ন হই আর ভাবি, সত্যি পৃথিবী আজ গভীরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

যখন রমনার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান থেকে নৈরাজ্য ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয় তখন নড়েচড়ে উঠি, সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফির কণ্ঠস্বর তখন শোনা যায়, যারা তাকে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করেছে, যারা তার সম্ভ্রম লুটের ছক কেটেছে, তাদের বিচারের দাবির ভেতর দিয়ে সে একটি অসুস্থ সামাজিক কাঠামোর শরীরকে উলঙ্গ করে দেয়। দিল্লির নির্ভয়া আর সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফি শনাক্ত করে দেয় সমাজের অসুখের উৎস্য কেন্দ্র।

নির্ভয়া আর রাফি, রাফি আর নির্ভয়া জানিয়ে দেয় কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়।
অভিবাদন রাফি, তোমাকে।

আবেদ খান: সম্পাদক দৈনিক জাগরণ।

এইচআর/পিআর

যখন রাফি নামের ওই অদেখা তরুণীকে দেখি, তখন একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ উৎসবের সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে, উৎসবের সমস্ত প্লাবন ও সুর মূর্ছনাকে চাপা দিয়ে, প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পরে। তখন আমি বিষন্ন চিত্তে ভাবি এ কোন অন্ধ গহ্বরে নিপতিত হতে চলেছি আমরা

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।