নুসরাত হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১২:০২ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

ফেনীর নুসরাত রাফি চলে গেছে। রয়ে গেছে, বেঁচে আছে সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হায়েনা সিরাজউদ্দৌলা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। নুসরাতের মৃত্যুতে আনন্দ উল্লাসে মত্ত নিশ্চয়ই সেইসব পরোক্ষ খুনিরা যারা সিরাজের পক্ষে মিছিল করেছে এবং যারা এই মিছিলে মদদ দিয়েছে।

সাহসী নুসরাত একটি অসম লড়াই করছিল। প্রভাবশালী অধ্যক্ষ, স্থানীয় পুলিশ আর প্রতাপশালী মহলের চোখ রাঙানিকে ভয় না পেয়ে সে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে গেছে। অবশেষে পরীক্ষার দিনে, কেন্দ্রের ছাদে নিয়ে তাকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

সবাই বিচার চাচ্ছে। কিন্তু কার বিচার, কীসের বিচার সে এক বড় প্রশ্ন। অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা প্রধান আসামী। কিন্তু যে পুলিশের ওসি প্রথমেই বলে ফেললেন নুসরাত আত্মহত্যাও করতে পারে, তার বিচার কি শুধুই প্রত্যাহার? কিংবা যারা রাস্তায় নেমে অধ্যক্ষের পক্ষে বক্তৃতা করেছে, মিছিল করেছে তাদেরও বিচার হবে? নাকি তাদের যারা নামিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে বিচার করা হবে?

ঢাকায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের বিচার হয়নি। নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি। কুমিল্লায় তনু ধর্ষণ ও হত্যার বিচার হয়নি। এরকম আরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে। এবার কি তাহলে বিচার হবে? কারণ নুসরাতের চিকিৎসার যাবতীয় খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। যদি এই ঘটনারও বিচার না হয় তাহলে প্রমাণ হবে যে এ দেশে ক্ষমতাই সব, প্রভাব আর প্রতাপই আইন।

ঘটনাটি আরেক দিক দিয়েও বিচার্য। এলাকার স্থানীয় মানুষেরা আগে যে দৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেখতেন, এখন আর সে ভাবে দেখেন না।

একটি পরিবার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করছে, অথচ তার পক্ষে সেই এলাকার কেউ দাঁড়ালো না। বরং বেশি করে সক্রিয় দেখা গেল নিপীড়কের পক্ষে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যথেচ্ছাচার সেই এলাকার মানুষের মজ্জাগত হয়েছে।

জামায়াতের উপজেলা আমীর অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। বহু বছর ধরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সে আছে। পুলিশের কথাবার্তা, বিশেষ করে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (যাকে পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে) আচরণ দেখে বোঝাই যায় এখানে বড় একটি প্রভাবশালী মহলের প্রশ্রয় রয়েছে, মদদ রয়েছে সিরাজউদ্দৌলার পেছনে।

নিপীড়ক সিরাজের পক্ষে মিছিল, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের এমন মনোভাব, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতার সিরাজের পক্ষে আইনী লড়াই চালানোর যে সামাজিক প্রবণতাটি দেখলাম এই ঘটনায় তা সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর। এটাই সর্বনাশের মূল।

এই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজই ব্যাধিগ্রস্ত দলও ব্যাধি উৎপাদন করেছে। যে সমাজ শিক্ষাক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আমোদের প্রাঙ্গণ হিসাবে দেখে, সেই সমাজের অবক্ষয় সম্বন্ধে আর কোন সংশয় থাকে না। আমরা উন্নয়ন নিয়ে গর্বিত, আমাদের মাথাপিছু আয় এখন অনেক বেশি। কিন্তু একই সাথে আমরা মানবিকতায় যে ষোলো আনা পশ্চাৎগামী, নুসরাত, সাগর-রুনি, তনু হত্যাকাণ্ড তারই প্রমাণ।

অপরাধ সব দেশেই হয়। কিন্তু বিচার হয়। কিন্তু আমাদের এখানে বিচার না হওয়ার এক রেওয়াজ চালু হয়েছে। একটা হল বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা। আরেকটি হলো প্রভাব খাটিয়ে বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়া। দ্বিতীয়টিই বেশি উদ্বেগজনক। আমরা সমাজকে যদি প্রগতির পথে নিতে চাই তাহলে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে। শরীরের কোন অঙ্গে পচন ধরলে চিকিৎসক প্রথমে তা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেই প্রয়াস সফল না হলে, শরীরের স্বার্থেই, সেই অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়। দুঃখের হলেও এই পথ অবলম্বন করতে হয়।

অনেকেই সিরাজউদ্দৌলার ফাঁসি চায়। ঘটনার নৃশংসতায় স্বতঃর্স্ফূত প্রতিবাদ হচ্ছে সর্বত্র। সবাই ভাবছেন এই ঘটনা তাদের নিজেদের বা কোন প্রিয়জনের হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যেকোন মূল্যে এই হত্যার বিচার করতে। আমরা আশাবাদী হতে চাই। কিন্তু অনেকগুলো বড় খুন ও অপরাধের বিচার না হওয়ায় পুলিশ বা সরকার সাধারণ মানুষের জন্য কোন প্রতিকার করবে এ আস্থা একেবার কমে গেছে।

যেমনটি ঘটেছে সড়ক পরিবকহন খাতে। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রশ্রয়ের কারণে নৈরাজ্যকেই নিয়ম করে নিয়েছে পরিবহন মালিক শ্রমিকরা। আমরা জানিনা শেষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার কিছু হবে কিনা, তবে যদি না হয় তবে আরো অনেক ঘটনা এমন ঘটতে থাকবে। কিছু হবে কিনা।

সরকার, প্রশাসন, পুলিশ কিছু করবে কিনা সে বিতর্ক চলবে। তবে পরিত্রাণের উপায় হল জনমত গড়ে তোলা। নামী প্রতিষ্ঠানে কিছু ঘটলে আন্দোলন হয়, কিন্তু এলাকার ছোট প্রতিষ্ঠানে কিছু হলে সকলেই চুপ করে থাকেন। নুসরাত কোন বড় প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ছিল না। তবে ঘটনাটি সাড়া ফেলেছে এর নিষ্ঠুরতার ধরনের কারণে। তনু হত্যার বিচার হয়নি, হয়নি আরো অসংখ্য খুন, ধর্ষণ আর অপরাধের। এটা চলতে পারে না। প্রতিটি মানুষের মর্যাদা আছে সে যত সাধারণই হোক না কেন।

স্থানীয় মানুষদের শিক্ষা-সংস্কৃতির মানোন্নয়নে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এলাকার প্রভাবশালীরা নিপীড়কের পক্ষে অবস্থান নিলে আইনের শাসন বলে কিছু থাকেনা। সিরাজউদ্দৌলার বড় সাজা হোক, মৃত্যুদণ্ড হোক এবং তা হোক দ্রুততার সাথে। মনে রাখা প্রয়োজন এমন মৃত্যু বহু জীবন বিনাশের সম্ভাবনা হ্রাস করে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম

একটি পরিবার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করছে, অথচ তার পক্ষে সেই এলাকার কেউ দাঁড়ালো না। বরং বেশি করে সক্রিয় দেখা গেল নিপীড়কের পক্ষে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যথেচ্ছাচার সেই এলাকার মানুষের মজ্জাগত হয়েছে।

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।