আর কত নুসরাতের বিনিময়ে তবে মিলবে বিচার?
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:৩৫ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০১৯
আমি জানিনা আসলে কী লিখতে হবে। সত্যি ভাবতে পারছিনা আর কত লেখা লিখতে হবে এই এক বিষয় নিয়ে? এ যেন থামছেই না। বেড়েই চলেছে আগুনের শিখার মত। কম ঘটনাতো ঘটছে না তাহলে কেন থামানো যাচ্ছে না এই নারী নির্যাতন?
অবশেষে চলেই গেলো নুসরাত রাফি নামের সোনাগাজীর সেই প্রতিবাদী মেয়েটি। জ্বি। একদম ঠিক পড়েছেন পাঠক। নুসরাত চলে গেছে এই পৃথিবী থেকে। হে প্রাণের বাংলাদেশ। নুসরাতরা এভাবেই চলে যায় তবুও তোমার বুকে নুসরাতদেরকে খুন করার অপরাধে কারও বিচার হয় না।
মাদ্রাসা শিক্ষক নাসিরুদ্দিনরা নুসরাতের মত আমাদের সকল নারীদেরকে তাদের শখের পুতুল বানিয়ে ফেলতে চাইছে। চাইছে কারণ প্রশ্রয় পাচ্ছে। হাতে গ্রিন কার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের সমাজের পুরুষেরা।
হয়তো অনেকেই বলবেন সকল পুরুষ এক নয় কিন্তু আমরা নারীরা কেমন করে বিশ্বাস করবো কোন পুরুষ কেমন? নারীরা যে আজ আর কোথাও নিরাপদ নয়। পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণের কাহিনী যেদিন পড়েছিলাম সেদিনই আমার পুরুষের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যেতে শুরু করেছে।
দুঃখিত আমার পুরুষসমাজ। না। আমি বা আমার মত কোটি নারী সত্যি পারছে না পুরুষের প্রতি আস্থার জায়গাটিকে শক্ত করে ধরে রাখতে। জানি এ দোষ আপনাদেরও না। এ দোষ আমার নারী পরিচয়ের। তনু, নুসরাতদের নারী পরিচয়ই হয়েছে তাদের মৃত্যুর কারণ। এই রাষ্ট্রে হয়তো অনেক অপরাধের বিচার হয় কিন্তু নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের বিচার চাওয়া যেন একরকম অপরাধ।
নুসরাতের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনিও তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখতে পারেন নি নুসরাতকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনারতো অনেক ক্ষমতা। আপনি চাইলেই এই রাষ্ট্র থেকে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অন্য সব ঘটনায় হয়তো আপনি অতটা যুক্ত থাকতে পারেন না তবে নুসরাতের পাশেতো আপনি প্রথম দিন থেকেই ছিলেন। আমরা জানতাম নুসরাত হয়তো আর ফিরে আসবে না তার পরিবারের কাছে কারণ ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নিয়ে কোন মানুষ বাঁচতে পারেনা আর বাঁচলেও সে মরার চেয়েও করুণ হতো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছেই আমাদের সকল ভরসা। আপনি প্রথম দেখিয়েছেন আমরাও পারি বিচারহীনতাকে চ্যালেঞ্জ করতে। জাতির জনকের হত্যার বিচারতো আপনি করেছিলেন আপা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও আপনি করেছেন। ৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের যারা খুন করেছিলো সেসব খুনি আর যারা আমাদের মা বোনদেরকে ধর্ষণ করেছিলো তাদেরকেও আপনি বিচারের আওতায় এনেছেন। নুসরাতের খুনিদেরকে ধরতে আপনি নির্দেশ দিয়েছেন।
পাশাপাশি আমরা সেইসব খুনিদের পক্ষেও মিছিল হতে দেখি। এও সম্ভব? এটাও সম্ভব যে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে খুনিদের পক্ষে মিছিল করার মত সাহস দেখায় কিছু লোক? তারা কারা যারা আপনার শাসনকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে?
৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনার বর্ণনায় আমরা পড়েছিলাম খুনিরা উৎসব করেছিল। যারা প্রতিবাদ করেছিল তাদেরকে টার্গেট করে ভয় দেখানো হয়েছিল। সে এক সময় ছিল যখন আপনাদের দুই বোনকে দেশে আসতে দেয়া হয়নি। পিতা, মাতা ও পরিবারের কারও কবরের কাছে যেতে দেয়া হয়নি। আপনজন হারানোর কষ্ট আপনার থেকে আর বেশি কে জানে এই বাংলায়?
কেউ না। সম্ভবও নয়। কিন্তু খুনিদের পক্ষে মিছিল হয় এই দৃশ্য কেমন করে মেনে যায় এই ২০১৯ সালে এসে? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপনি দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। এদেশের আপামর মানুষ আপনার উপর ভরসা রেখেছে তৃতীয়বারের মত। আরও রাখতে চায়। আমরা চাই আপনার হাত ধরেই আসুক এই বাংলার বুকে নারীদের মুক্তি। সকল নারী নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত হোক। একটি ঘটনাও যেন বিচারের বাইরে চলে না যায়।
আমরা দেখেছি ফেনীর ঘটনায় থানার ওসি কেমন করে খুনিকে বাঁচানোর কৌশল নিয়েছে। মামলা নিতেও ছিলো গড়িমসি। কেন? আপনার শাসনামলে থেকে এরা কারা যারা নারীদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে চায়? আপনি নির্দেশ দেয়ার পরও গ্রেফতারে আলসেমি দেখায়। নানা ছুঁতোয় বাঁচিয়ে দিতে চায় সন্ত্রাসীদের।
আমরা জানিনা। আসলেই জানিনা কে শক্তিশালী এই রাষ্ট্রে। নুসরাতের মত একজন প্রতিবাদী কণ্ঠ যদি এভাবে হারিয়ে যায় তাহলে এ বাংলা কি প্রতিবাদহীন হয়ে যাবে? কতটা প্রাণ শক্তি নিয়ে লড়ে যাচ্ছিলো মেয়েটি। অই পোড়া শরীরেও সে জবানবন্দী দিয়ে গেছে খুনিদের বিরুদ্ধে।
যারা নুসরাতকে এভাবে জ্যান্ত কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে তাদের কি কোন অধিকার আছে এই দেশে বেঁচে থাকার? আমরা কি এমন বাংলাদেশে বাস করি যেখানে নুসরাতদের জীবন দিতে হয় ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় আর ধর্ষক, খুনি নাসিরুদ্দিনরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আরও নুসরাতদেরকে শিকার বানানোর জন্য?
আমরা বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস রাখতেই চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর। এই ঘটনার যদি বিচার না হয় তবে ধরেই নিব এ দেশে নারীদের আর বেঁচে থাকার মত কোন সুযোগ নেই। এই রাষ্ট্র চায় না নারীরা বেঁচে থাকুক। যদি বলা হয় যে প্রত্যক্ষভাবে এই প্রশাসন নাসিরুদ্দীনের মত খুনিদেরকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে আরও বেশি বেশি নারী নির্যাতনের তাহলে কি ভুল বলা হবে?
গোটা দেশ আজ থমকে গেছে নুসরাতের মৃত্যুতে। আমরা সবাই যারা নিজেদেরকে মানুষ হিসাবে পরিচয় দেই কেবল একটি ঘটনার বিচার চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নুসরাতের হত্যার ঘটনার বিচার দিয়েই যেন শুরু হয় এদেশে সকল প্রকার নারী নির্যাতনের। প্রশাসনের ভিতরে যেসকল নারী নির্যাতনকারী আছে তাদেরকেও খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
যে ওসি মামলা নিতে চায়নি, খুনিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলো তাকে কেবল ওএসডি বা বদলি করেই যেন দায়সারা না হয়। শাস্তি দিতে হবে সেই পুলিশকেও। তাহলেই তারা বুঝতে পারবে এটি কোন অসভ্যের সমাজ নয়। এখানে অসভ্যতার বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সক্রিয় থাকে।
দিনের পর দিন নারীবিদ্বেষী প্রচারণাকে বন্ধ করার উদ্যোগ দেখতে চাই। এই সমাজে নারীরাও সমান ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নারীরাও পিছিয়ে নেই। নারীদেরকে হেয় করে দেখার মানসিকতাকে আঘাত করতে হবে শাস্তির মাধ্যমে।
সমাজে সাম্য বজায় না রাখতে পারলে কোন উন্নয়নই টিকসই হবে না। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না করে কেবল সাময়িক উন্নয়নের পিছনে আমরা দৌড়াতে চাইনা। সুবিচার আর উন্নয়ন কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয় বরং পরিপূরক।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম
নুসরাতের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনিও তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখতে পারেন নি নুসরাতকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনারতো অনেক ক্ষমতা। আপনি চাইলেই এই রাষ্ট্র থেকে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে না।