অফুরান অফারে প্রতারণার ফাঁদ : অসংখ্য সিম নিবন্ধন

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:২২ এএম, ১০ এপ্রিল ২০১৯

নানা অপরাধের সঙ্গে সমানে প্রতারণাও হচ্ছে মোবাইল ফোনে। কখনও বিকাশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ফোন করে অ্যাকাউন্ট সেটিং করার নামে, কখনও লটারিতে গাড়ি-বাড়ি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলছে প্রতারণা। সহজ-সরল অনেকে না বুঝে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত টাকা স্থানান্তরের সুন্দর ব্যবস্থাটির মধ্যেও পড়েছে দুষ্টু চক্রের হাত।

প্রতিদিন সারা দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গিয়ে শত শত মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। এর শিকার অনেকে লোকলজ্জায় তা প্রকাশ না করে চেপে যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের কয়েকটি স্থানে প্রতারকচক্রের জাল বিস্তার শনাক্ত করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

পুলিশ বলছে, মোবাইল ফোনে প্রতারণা বন্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ প্রতারকরা অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করছে। ওইসব নম্বর দিয়ে প্রতারকরা শুধু শিকারদের সঙ্গেই কথা বলে। এ কারণে মোবাইলের কললিস্টের সূত্র ধরে প্রতারকদের শনাক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। এর একটা বিহিত অবশ্যই দরকার। এর মাঝে আবার টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির বরাতে নানা অভিযোগ মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগের কোনো কোনোটি গুরুতর। উদ্বেগজনক। রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর। বিটিআরসির সভার কার্যপত্রেও উঠে এসেছে এমনতর কিছু অভিযোগের সবিস্তার বর্ণনা। সাধারণ গ্রাহকের পাশাপাশি মন্ত্রী-আমলা পর্যায়ের ভিআইপিদের হয়রানের চাঞ্চল্যকর ঘটনাও উঠে এসেছে এ বর্ণনায়। এ নিয়ে কিছু নির্দেশনা ও চিঠি চালাচালি হচ্ছে।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলামও পড়েছেন হয়রানিতে। তাদের ‘প্রিমিয়াম’ মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য গ্রাহককে। বিটিআরসি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাছে। কিছু ব্যাখ্যা পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যার বদলে জুটেছে চাতুরি। এমন কি ধৃষ্টতাও। প্রতিমন্ত্রী এবং ডিজির নম্বর এরইমধ্যে ঠিক করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু, এ ধরনের হয়রানিতে পড়া বাকিরা তো প্রতিমন্ত্রী বা কোনো সংস্থার ডিজি নন। তাদের কী হবে?

গ্রাহকদের অভিযোগ দৃষ্টে রবি, বাংলালিঙ্ক, গ্রামীণসহ বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়মের এন্তার তথ্য পেয়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু চুনোপুঁটি ধরাও হচ্ছে। মাস কয়েক আগে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ করপোরেট সিম বাইরে বিক্রির অভিযোগে গ্রামীণফোনের এক বিপণন কর্মকর্তা ও একজন পরিবেশককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তারা জেনেছে, কালোবাজারে বিভিন্ন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যুকৃত এসব করপোরেট সিম উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে জঙ্গি, চাঁদাবাজ, অপহরণকারী, সন্ত্রাসীদের কাছে। এ কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের সিম ব্যবহারকারীদের শনাক্ত করতে হিমশিম খায়। কখনো কখনো শনাক্ত করতে পারেই না।

এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে বিটিআরসি করপোরেট গ্রাহকদের জন্য সিম উত্তোলন, প্রতিস্থাপন, হস্তান্তর ও নিষ্ক্রিয়করণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের প্রধানের জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। এদিকে, মোবাইল ফোনের সিমকার্ড নিবন্ধনও হচ্ছে যথেচ্ছা। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের পরও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে হুমকি, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নারীদের উত্ত্যক্ত করা থেমে নেই।

অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ভুয়া নিবন্ধিত সিম কিনে এসব অপরাধ করছে। একটি জাতীয় পরিচয়পত্র-এনআইডির বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৫টি মোবাইল ফোনের সিমকার্ড নিবন্ধনের বিধান থাকলেও তা হচ্ছে ভয়ানক পর্যায়ে। সেটা খুঁজতে গিয়ে হতভম্বকর তথ্য পেয়েছে -বিটিআরসি।

একটি এনআইডি নম্বর দিয়ে ৪২ হাজার সিম নিবন্ধনের তথ্য সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। কিছু প্রতারকও পছন্দের সংখ্যার নম্বরগুলো তুলে অন্য গ্রাহকের কাছে বেচে দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না অপারেটর বা কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা ছাড়া এ অপকর্ম সম্ভব নয়। বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগ থেকে অপারেটরগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হেছে, প্রতিটি সিম নিবন্ধন নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অপারেটরের।

এর আগে কেবল অনিবন্ধিত সিম ধরা পড়লে প্রতিটির ক্ষেত্রে ৫০ ডলার হারে জরিমানা গুণতে হতো। এটাকে সুযোগ হিসেবে নেয় অপারেটররা। এখন বিষয়টি পরিষ্কার করে চিঠিতে বলা হয়েছে, মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিয়ে কোনো সিম রেজিস্ট্রেশন হলে তার দায়-দায়িত্ব অপারেটরের। এজন্য তাদের ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হবে।

বিটিআরসির তথ্য হচ্ছে: বর্তমানে একটি এনআইডির বিপরীতে ১৫টির বেশি সিম রয়েছে ২৬ লাখ ৩০ হাজার। এরইমধ্যে সবগুলো মোবাইল ফোন অপারেটরকে চিঠি দিয়ে সর্বশেষ কেনা ১৫টি নম্বর রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। এ বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানটির নির্দেশনা হচ্ছে, ভুয়া সিম নিবন্ধনের দায় মোবাইল ফোন অপারেটরকেই নিতে হবে।

আশা করা হয়েছিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সিম নিবন্ধন এবং বায়োমেট্টিক ভেরিফিকেশনের পর মোবাইল ফোন ব্যবহার করে হুমকি, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নারীদের উত্ত্যক্তের শঙ্কা কমে যাবে। এরপরও ২০১৭ সালে একটি পরিচয়পত্রের বিপরীতে কতটি সিম থাকতে পারে তখন সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।

পরে নিবন্ধন এবং বায়োমেট্টিক ভেরিফিকেশন শেষে সেই সংখ্যা ১৫টি বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু, এ বিধিনিষেধ মানা হয়নি। এখন বিটিআরসি ‘সেন্ট্রাল বায়োমেট্টিক ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত রয়েছে সব অপারেটর। এতে সহজেই জানা যাচ্ছে অতিরিক্ত সিমের সংখ্যা। গ্রাহকরাও চাইলে নিজেই জেনে নিতে পারেন তার নামে নিবন্ধিত সিমের সংখ্যা।

গ্রাহক স্বার্থে বিটিআরসি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেও কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে মোবাইল অপারেটরদের ঠকবাজি অফার দমনে পিছুটান স্পষ্ট। অফুরান অফার দিয়েই যাচ্ছে তারা। মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন অফার ও ইন্টারনেট প্যাকেজ মনিটরের সিদ্ধান্ত থেকে বিটিআরসি সরে এসেছে কি-না পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে গ্রাহকদের কয়েক হাজার অভিযোগ বিটিআরসিতে জমা পড়ায় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

গত মার্চে বিটিআরসির বোর্ড মিটিংয়ে মনিটরিং সেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা নেই। বলা হয়েছিল মনিটরিং সেল যে কোন অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করবে। তদন্তে প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণ হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

অপারেটরদের এ বিষয়ে বিটিআরসি কয়েক দফা চিঠি দিয়ে সতর্কও করেছে। বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন প্যাকেজ ও অফার দিচ্ছে মোবাইল অপারেটররা। দিনের কোন অংশে কত পয়সা মিনিট বা সেকেন্ড, আবার কোন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা রিচার্জ করলে ‘এত মিনিটি ও এত এসএমএস ফ্রি’।

এসব অফার পাঠিয়ে গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। গ্রাহকরা এসব অফার গ্রহণ করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। একইভাবে ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। মোবাইল গ্রাহকরা এসব এসএমএস’র কারণে এখন অতিষ্ঠ। এরপরও অপারেটররা কাজটি করেই যাচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

গ্রাহক স্বার্থে বিটিআরসি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেও কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে মোবাইল অপারেটরদের ঠকবাজি অফার দমনে পিছুটান স্পষ্ট। অফুরান অফার দিয়েই যাচ্ছে তারা। মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন অফার ও ইন্টারনেট প্যাকেজ মনিটরের সিদ্ধান্ত থেকে বিটিআরসি সরে এসেছে কি-না পরিষ্কার নয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।