নীতিমালার চিকিৎসা জরুরি
আগুন লাগে। মানুষ পোড়ে। মানুষ মরে। কিছু মানুষ আহাজারি করে। কিছু মানুষ নড়েচড়ে বসে। টেলিভিশন টক-শোতে অনেকে অনেক জ্ঞানগর্ব কথা বলেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণের কথা বলেন। নীতিমালা মেনে ভবন নির্মাণের কথা বলেন।
দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী থেকে প্রশাসনের লোকজন কর্তব্য পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। আইনকানুন না মেনে ভবন নির্মাণ করলে কঠিন শাস্তির কথা বলেন। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। শুনতে ভাল লাগে। মনে আশা জাগে। মনে হয় আর বোধহয় কোন ভবনে আগুন লাগবে না। আর কোন ভবন ধসে পড়বে না। আর কোন মানুষ পুড়ে মারা যাবে না। আর কারো স্বপ্ন আগুন পোড়া হবে না!
কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই আশা সময়ের স্রোতের হারিয়ে যায়। মানুষের মনের ক্ষোভের আগুনও হয়তো কিছু দিনের জন্য স্তিমিত হয়। আবার একটা আগুন লাগে, আরো কিছু মানুষ মারা যায়, তখন মনে হয় নীতিমালা, কর্তব্য এই শব্দগুলো শুধুই বইয়ের পাতায় আছে। মানুষের মুখে আছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই। থাকলেও সেই ভবন নির্মাণ নীতির স্বাস্থ্য ভাল নেই। তারও চিকিৎসা দরকার। কিন্তু চিকিৎসা করাবেন কে?
এই প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যায় না বলেই বার বার আগুন লাগে। বার বার ভবন ধসে পড়ে। প্রতিদিন মানুষ রাস্তায় বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। পঙ্গু হয়ে যায়। আধা-মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকার নামে কিছু দিনের জীবনযুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করে। আইন আদালত থেকে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে কিছু ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা দেয়া হলেও সেটা পরিশোধ করা নিয়ে চলে গড়িমসি। পা- হারা, হাত-হারা মানুষগুলো আদালতের বারান্দা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমরাও সবাই ধরে নেই এটাই নিয়তি!
অগ্নিঝুঁকিতে এই মহানগরীর কতগুলো ভবন আছে, তার কী কোন পরিসংখ্যান আছে? জোর দিয়ে বলা যায় এই সংখ্যাটা পাওয়া কঠিন। কারণ, তথ্যটা দিবেন কারা? বিল্ডিং কোড মেনে এই শহরের ক'টা বিল্ডিং হয়েছে? কারা তার ছাড়পত্র দিয়েছেন? এইসব বড় বড় প্রশ্নের উত্তর যেখানে পাওয়া যায় না, সেখানে কতোগুলো বাড়ি বা ভবন ঢাকা শহরে ঝুঁকিপূর্ণ তা বলবেন কে?
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই বড় বড় দুটো অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী। প্রথমটা পুরোনা ঢাকার চকবাজারে। সেখানে আগুনের কারণ নিয়ে অনেক গবেষণা। দাহ্য পদার্থের গোডাউন, এরকম অনেক কারণ আছে। অনেক বক্তব্য আছে। এরপর বনানী ট্র্যাজেডি। সেখানে নিশ্চয়ই ক্যামিক্যাল গোডাউন ছিল না। কিন্তু আকাশচুম্বী ভবনটা আকাশ ছুঁই ছুঁই করে উপরের দিকে উঠলো কীভাবে?
ডিআইটি থেকে নাম বদলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক হলো। কিন্তু তাতে শুধু অবৈধ বা নিয়ম কানুন না মেনে বিল্ডিং এর পর বিল্ডিং হলো এবং হচ্ছে। কিন্তু নিয়ম মেনে হচ্ছে কী হচ্ছে না সেটা দেখছেন কারা? সেখানে কী লোকবল আছে, না নেই। আগুন লাগলে দমকল বাহিনীর সদস্যরা প্রাণপাত চেষ্টা করেন আগুন নেভানোর। কিন্তু তাদের আধুনিকায়ন হলো কী হলো না সেটাও বিবেচনা করার সময় এসেছে। ঢাকা শহরে আগুন লাগলে পানি সংকট। আধুনিক যন্ত্রপাতি অপ্রতুল।
এসব তো আছেই। কিন্তু তারচেয়ে আইন সংস্কার আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। দমকল বাহিনীকে ফোন করলেই চলে আসবে স্পটে। হয়তো আসেও। কিন্তু এই বাহিনী কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সেটা স্থানীয় সরকার, নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে? এই দমকল বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রস্তাবটা সরকারকেই বা কারা দেবেন? এগুলো আলোচনা করে সরকারের কাছে প্রস্তাব যাওয়া জরুরি। কারণ, মানুষ যেন আর পুড়ে না মরে। ভবন চাপা না পড়ে।
পুরনো ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে। চারশ’ বছরের পুরনো একটা শহরের বড় একটা অংশের সংস্কার সহজ কথা নয়। কিন্তু ধাপে ধাপে করা যায় কী না সেটা ভেবে দেখা দরকার। না হলে স্বপ্নপোড়া এই আগুন হয়তো আরো দাউ দাউ করে আগামীতে জ্বলবে। কখনো বস্তি। কখনো ভবন। পুড়বে অনেক কিছু। মারবে অনেক মানুষ। শুধু পাওয়া যাবে না দায় নেয়ার মানুষ। কিন্তু এভাবে কতোদিন!
এই শহরে মানুষ পুড়ে মরে। চাকাপিষ্ট হয়ে মরে। শুধু মৃত্যুর মিছিল বাড়ে। মানুষের শোকের মতম হয়। কখনো কখনো ক্ষুব্ধ কিশোর-তরুণরা রাস্তায় নামে। ব্যানার হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে- 'রাষ্ট্রের মেরামত চলছে!'
আসলে রাষ্ট্রের মেরামতের আগে নিয়ম-নীতির স্বাস্থ্য ফেরাতে হবে। তার চিকিৎসা করতে হবে।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস