এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করুন

লীনা পারভীন
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:২৫ এএম, ০১ এপ্রিল ২০১৯

কয়দিন পরপরই বিভিন্ন জায়গায় আগুন লেগে সারি সারি মানুষ মারা যাচ্ছে। সড়কে গাড়ি চাপা পড়ে মরছে মানুষ। একেকটি ঘটনা ঘটার পর আমরা কিছুদিন সরব থাকি তারপর সব ঠিকঠাক।

এই যে বনানীতে ২৫টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল বিনা দোষে এর দায় কে নিবে? পরিবারগুলোর হাহাকার কে থামাবে? যে মানুষগুলো সকালে কাজে এলো একটি নতুন দিনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে সে মানুষগুলোর সারাদিনের শ্রমের অর্থ কিন্তু দিনশেষে রাষ্ট্রীয় কোষাগারেই জমা হয়। তারমানে দেশের এই যে উন্নয়ন এগুলোর একটিও সম্ভব হতো না এই সাধারণ মানুষগুলোর অবদান বিনা। আর এত বড় বড় বিল্ডিং এর মালিকদেরকেও আর ঢাকা শহরের বুকে রাজ করে বেড়াতে হতো না যদি না আমাদের মতো মানুষগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

পুরান ঢাকার চুরিহাট্টার ঘটনা এখনও আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া মানুষগুলোর শেষ মুহূর্তের বেঁচে থাকার আকুতিটুকু কী আমাদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব? মোটেও সম্ভব না। বনানীর এফ আর টাওয়ারের যে লোকটি আগুনের হাত থেকে বাঁচতে লাফ দিয়েছিল সে কী ভেবেছিল যে আগুন থেকে বাঁচতে গিয়ে সে আরেকটি মরার পথ বেছে নিয়েছিল? ছিলো না। কারণ তার সামনে তখন কেবল বাঁচার আকুল কান্না। বাছ বিচার করার মত সময় তিনি পাননি।

জানা যাচ্ছে বিল্ডিংটি রাজউকের নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়নি। প্রশ্ন আসে তাহলে রাজউকের কাজ কী? ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে একেকটি সুউচ্চ বিল্ডিং বানানো হচ্ছে অথচ কোন মনিটরিং নেই তারা নিয়ম মানছে কি মানছে না। এমন খুঁজতে গেলে দেখা যাবে শহরের কোন বিল্ডিং এ নিয়ম মেনে বানানো হচ্ছে না। এত অনিয়ম নিয়ে একেকের পর এক বিল্ডিং উঠছে কেমন করে? পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের অনুমতি দিচ্ছে কারা? রাজউকের অনুমতি না থাকলে নিশ্চয়ই এসব সম্ভব ছিল না।

ঢাকা শহরে সমস্যার অন্ত নেই। নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে এই শহরে টিকে থাকতে। বেকারত্ব, নিম্ন আয়, বাসস্থানের সংকটসহ নানামুখী সমস্যা নিয়ে দিন শুরু ও শেষ হয় আমাদের এই দুই কোটি মানুষের শহরে। তার পরেও যদি রাস্তায় বের হয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটুকু না পাওয়া যায় তাহলে আর বেঁচে থাকাই কেন?

রাজউকের দুর্নীতি কে না জানে? একের পর এক অন্যায় করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে কেন? ঢাকা শহরকে বসবাসের উপযোগী করতে যখন সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী চেষ্টা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন আর এর পাশাপাশি আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় অকাতরে জীবন যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। ঢাকা শহরের কয়টি আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনে ইমার্জেন্সি এক্সিটের রাস্তা আছে? কয়টি বিল্ডিং এ অগ্নিনির্বাপণের সুব্যবস্থা রয়েছে? কেবল ব্যবস্থা থাকলেই চলবে না সেগুলোকে সঠিক নিয়মে মেইনটেইনও করতে হবে এগুলো নিয়ে কারও কি কোনো মাথা ব্যথা আছে?

একটি নগর, কর্তৃপক্ষ অনেক কিন্তু এদের মধ্যে সমন্বয়টা আসলে কোথায়? জানা গেছে এফ আর টাওয়ারে কোন ইমার্জেন্সি এক্সিট ছিলো না এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাও নাকি ছিল না। তাহলে কথা হচ্ছে এদের প্ল্যান রাজউক পাস করলো কেমন করে?

যদি ধরেও নেই যে তারা প্ল্যান সঠিকভাবেই পাস করেছিলো কিন্তু পরবর্তীতে নিয়ম মানেনি তাহলে রাজউকের মনিটরিং টিমের কাজ কী? কেন তারা সেই বিল্ডিংটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়নি? তাদের গাফিলতির জন্য যে এভাবে সাধারণ মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে তার জন্য কেন সেসব কর্তৃপক্ষকে এবং বিল্ডিং মালিককে শাস্তির আওতাও আনা হবে না?

প্রতিটা ঘটনার পরপরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় অথচ সেসব কমিটির রিপোর্টে কী ছিলো বা রিপোর্ট অনুযায়ী কতটা কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো সেগুলোর একটিও জানা যায় না। এভাবে করে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে। আর যারা অন্যায় করতে অভ্যস্ত তারা ধরেই নিয়েছে কিছু টাকা ঘুষ দিলেই সব ঠিক। অনিয়মের জন্য অন্তত এই দেশে কোন শাস্তির বালাই নেই। এই “ছাড়পত্র” পেতে পেতেই নতুন নতুন অনিয়মের জন্ম হচ্ছে।

একদিকে সড়কে নিরাপত্তা নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে জীবিত ফিরবো কি-না জানি না আমরা কেউ। তার মধ্যে যুক্ত হয়েছে বিল্ডিং এ আগুনের আক্রমণ। এভাবে দম বন্ধ করে বেঁচে থাকার নাম বেঁচে থাকা নয়। এর জন্য জনগণ বছরের পর বছর কর দেয় না। নাগরিক সুবিধা যদি নিশ্চিত করা না যায় তবে সেই ব্যর্থতাকেও স্বীকার করে নেয়ার মতো সৎসাহস দেখানো চাই।

ফায়ার সার্ভিসের যারা কাজ করেন তাদের রয়েছে নানা রকম জটিলতা। যথেষ্ট লজিস্টিক সাপোর্ট নেই এ কথা শুনে আসছি দিনের পর দিন। অথচ এর থেকে উত্তরণের কোন উদ্যোগ দেখছি না। কে জানে হয়তো রানা প্লাজা ঘটনার পরই বাজেট দেয়া হয়েছিলো কিন্তু সেই বাজেটের যথাযথ হিল্লা হয়নি। হয়তো কেঁচো খুঁড়তে সাপও বের হয়ে আসতে পারে।

উঁচু উঁচু বিল্ডিং বানানোর অনুমতি দেয়া হচ্ছে অথচ সে বিল্ডিং গুলোতে কোন অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তাকে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট লজিস্টিক সাপোর্ট আমাদের বাহিনীগুলোর আছে কিনা সেটাও খেয়াল করার মত কেউ নেই। ভাবতেই নিজেকে অসহায় লাগে যে এমন এক দেশের নাগরিক আমরা যেখানে আমাকে নিয়ে চিন্তার মতো কেউ নেই। সবাই আছে যার যার ধান্দা আর চুরির চিন্তায়।

অনেক হয়েছে। আর নয়। আমরা চাই সরকার এবার কঠোর হবেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঠিক ভূমিকা দেখতে চাই। সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের যারা এফ আর টাওয়ারের ঘটনার পিছনে ভূমিকা রেখেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ নিয়ম ভঙ্গ করার সাহস না পায় অন্তত সে ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সবার দাবি।

বিল্ডিং মালিকদেরকে নিয়ম মানতে বাধ্য করতে রাজউক এবং অন্যান্য বিভাগের কঠোর হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কারণ প্ল্যান পাস করে রাজউক আর রাজউকই একমাত্র পারে এই শহরের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে। দুই একটা ঘটনার শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অন্তত আমরা বুঝতে পারবো যে এ দেশেও আইনের শাসন কায়েম সম্ভব।

আমাদের মন্ত্রী বলেছেন এটি একটি গাফিলতি এবং পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের শাস্তিও নিশ্চয়ই আমরা দেখতে পারব। সেই আশাতেই রইলাম।

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/এমকেএইচ

বিল্ডিং মালিকদেরকে নিয়ম মানতে বাধ্য করতে রাজউক এবং অন্যান্য বিভাগের কঠোর হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কারণ প্ল্যান পাস করে রাজউক আর রাজউকই একমাত্র পারে এই শহরের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।