সব সম্ভবের দেশ

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ০১ এপ্রিল ২০১৯

আমি আসলে লোক ভালো নই। কোনো কিছু ঘটলেই আমার মনে কুচিন্তা আসে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই মনে হয়; আসলে দুর্ঘটনা নয়, কেউ বুঝি পরিকল্পনা করে ঘটিয়েছে।

আমি জানি, অনেকগুলো দুর্ঘটনা সত্যি সত্যি দুর্ঘটনাই। তবে কেন জানি মনে হয়, আমরা যদি আরো সতর্ক হই, সঠিকভাবে যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন করি; তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু যেটা আসলে পরিকল্পিতভাবে করা হয়, সেটি তো দুর্ঘটনা নয়।

যেমন, কোনো বস্তিতে আগুন লাগার খবর শুনলেই মনে হয়, নিশ্চয়ই বস্তিটি খালি করা হবে। গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার খবর শুনেও আমার মনে কুচিন্তা আসে। এই মার্কেটটি নিয়ে অনেকদিন ধরেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন চলছে। সরকার মানে সিটি করপোরেশন এখানে একটি বিশ্বমানের শপিং মল বানাতে চায়। কিন্তু এখনকার ব্যবসায়ীরা কিছুতেই তাদের দখল ছাড়তে রাজি নন। এর আগেও ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি এই মার্কেটে আগুন লেগেছিল বা লাগানো হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা যায়নি। ধ্বংসস্তুপেই আবার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এবার হয়তো অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাবেন।

কোটিপতি থেকে পথের ফকির বনে যাওয়া ব্যবসায়ীদের জন্য আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে। কিন্তু তারাও এ আগুনের দায় এড়াতে পারবেন না। কারণ ২০১৭ সালের আগুনের পর ফায়ার সার্ভিস অনেকগুলো ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও ব্যবসায়ীরা তার কিছুই করেননি। শুধু ব্যবসাটাই করেছন, নিরাপত্তার কথা ভাবেননি।

ডিএনসিসি মার্কেটের আগুন দুর্ঘটনা হোক আর ব্যবসায়ীদের হটিয়ে বিশ্বমানের শপিং মল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে লাগানোই হোক; টাইমিংটা ভালো হয়েছে। ভোরে যখন আগুন লেগেছে বা লাগানো হয়েছে, তখন মার্কেটে কেউ ছিলেন না। তাই গুলশানের আগুনে কেউ মারা যাননি। এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির। কারণ গোটা মার্কেট পুড়ে গেলেও সেটা আবার বানানো যাবে। কিন্তু একজন মানুষের জীবনও ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য কারো নেই। ডিএনসিসি মার্কেটের আগুনের পরপরই যখন আবার অনেকেই বলতে শুরু করলেন, এখানে বিশ্বমানের শপিং মল করা হবে, তখন আমার মনের কুচিন্তাটা আরো জোরালো হয়।

বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের পরও আমার মনে কুচিন্তা এসেছিল, ২৬ জন মারা যাওয়ায়, সেটা বলার সাহস পাইনি। কিন্তু এখন দেখছি আমার চেয়েও খারাপ লোক আছে দেশে। অনলাইনে দেখলাম এফ আর টাওয়ারের জমির মালিকের সাথে ডেভেলপারের ঝামেলা ছিল। জমির মালিক আগে থেকেই টাওয়ারের নিচে নাশকতার আশঙ্কা করে নোটিশ লাগিয়ে রেখেছিলেন। তার মানে এখানেও ঝামেলা থাকলেও থাকতে পারে।

নাশকতা হোক আর দুর্ঘটনা, এর বীজ কিন্তু আমরা রোপণ করে রেখেছি, ভবন বানানোর সময়ই। এফ আর টাওয়ারে আগুনের পর এখন অনেককিছু বেরিয়ে আসছে। আমি পূর্তমন্ত্রীর সাথে একমত। নাশকতা যদি নাও হয়, তবুও এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।

কার দায় কতটা, তা নিয়ে টানাহেঁচড়া চলছে। কিন্তু দায় সবাইকেই নিতে হবে। রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, এমনকি ভবনটির স্থপতিও দায় এড়াতে পারবেন না। আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না রেখেই, মানুষকে উদ্ধারের ব্যবস্থা না করেই এমন একটি ভবনের ডিজাইন করলেন কোন ইঞ্জিনিয়ার, কোন স্থপতি? রাজউকের কোন কর্মকর্তা তা অনুমোদন করলেন, কেন করলেন, কীসের বিনিময়ে?

১৮ তলার নকশায় একটি ভবন ২৩ তলা বানিয়ে বনানীর মত জায়গায় সবার চোখের সামনে আমাদের দুর্নীতির, অসততার, খামখেয়ালীর, ক্ষমতার অপব্যবহার, অদক্ষতা, অমানবিবতার প্রতীক হয়ে ১৪ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে; অথচ আমাদের কারো চোখেই পড়েনি।

কেন পড়েনি? নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বিনিময় আমাদের চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। এখন পূর্তমন্ত্রী দাবি করছেন, এফ আর টাওয়ারের আগুন আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। তিনি দাবি করছেন, সব অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন তিনি। যে লড়াইটা তিনি শুরু করতে যাচ্ছেন, সেটা অনেক কঠিন লড়াই। শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া কঠিন। আর কেউ থাকুক আর না থাকুক, আমি শেষ পর্যন্ত থাকবো তার লড়াইয়ে।

কিন্তু বাংলাদেশে কোনো অভিযানের কথা শুনলেই আমার খারাপ মনে কুচিন্তা আসে। মনে হয় যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান মানেই ট্রাফিক পুলিশের ঘুষের রেট বেড়ে যাওয়া, মাদকবিরোধী অভিযান মানেই মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার পকেট ভারি, সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান মানে পুলিশের পোয়াবাড়ো, অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান মানে কি রাজউকের আরো কারো কারো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করা? যত অভিযান, তত উপরি। অভিযান যত কড়া, রেট তত চড়া।

এফ আর টাওয়ারকে রাজউক নোটিশ দিয়েছে, ফায়ার সার্ভিস নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু আমরা তো নোটিশে কাবু হওয়ার লোক নই। ক্ষমতা থাকলে এসব নোটিশকে আমরা থোরাই কেয়ার করি। টাকা দিয়ে আমরা ক্ষমতা কিনে নেই। তাই নোটিশ দিয়ে কাজ হবে না। আমাদের ঘাড় ধরে করাতে হবে।

রাজউক এতদিনেও এফ আর টাওয়ারের বাড়তি পাঁচটি ফ্লোর ভেঙে দেয়নি কেন? এখন জানা যাচ্ছে, বিএনপি নেতা তাসভির তার দল ক্ষমতায় থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাড়তি ফ্লোরগুলো বানিয়েছিলেন। দুর্ঘটনার দায় একজন বিএনপি নেতার ঘাড়ে দেয়া গেছে ভেবে, অনেকে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। যাক এবার পাওয়া গেছে। সবার আগে তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতা হারিয়েছে ১৩ বছর আগে।

আওয়ামী লীগ ১০ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। এখন কি আর বিএনপি নেতার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পাড় পাওয়া যাবে? দায় যদি চাপাবেনই, তাহলে এতদিন তাসভিরকে গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? আর শুধু তাসভিরকে গ্রেপ্তার করলেই তো হবে না। যাদের প্রশ্রয়ে তাসভির হাওয়ায় পাঁচ তলা বানিয়ে ফেলে, ধরতে হবে তাদেরকেও।

পুরান ঢাকা যখন গড়ে ওঠে, তখন না হয় ডিআইটি বা রাজউক ছিল না। কিন্তু নতুন ঢাকা মানে ধানমন্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা তো ডিআইটি বা রাজউকের চোখের সামনেই হয়েছে। কিন্তু কয়টি ভবন নিয়ম মেনে হয়েছে? অধিকাংশ ভবনেই কোনো না কোনো বিচ্যুতি আছে।

কিভাবে হলো? এখন যদি পূর্তমন্ত্রী সব ভবনের অনিয়ম ভাঙতে যান, ঢাকা তো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। এফ আর টাওয়ার তো ঢাকায় একটা না; শত শত, হাজার হাজার। ভবনগুলো গড়ে ওঠার সময় রাজউক দেখেনি কেন? এই যে ঢাকায় আবাসিক এলাকাগুলোর চরিত্র বদলে যাচ্ছে, রাজউক দেখছে না কেন, ঠেকাচ্ছে না কেন? একটা ভবন বানিয়ে ফেলার সেটা ভাঙ্গা কঠিন। একটি এলাকার চরিত্র বদলে যাওয়ার পর তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া কঠিন। যা করতে হবে, শুরুতেই।

রাজউকের মত একটা প্রতিষ্ঠান থাকতে যদি এমন অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়, তাহলে আর রাজউককে রাখার দরকার কি। কিছু কর্মকর্তার ঘুষ খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান রাখার কোনো মানেই হয় না। তবে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। পরিকল্পিত ও নিরাপদ নগর গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে রাজউককে ঢেলে সাজাতে হবে।

একটা গল্প বলে লেখাটি শেষ করছি। এখনও কঠিন, তবে একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া আরো অনেক কঠিন ছিল। নানা রকমের কাগজপত্র দিতে হতো। তো এক ছেলের কাছে একের পর এক নানান কাগজ চাইতে লাগলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ছেলেটি ভিসা অফিসারকে বললো, ভিসা দিবেন কিনা বলেন, কাগজ কোনো সমস্যা না। যে কাগজ চান, তাই পাবেন; এমনকি আমার ডেথ সার্টিফিকেটও।

আসলেই বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। এখানে ১৮ তলার অনুমতি নিয়ে ২৩ তলা ভবন বানিয়ে ফেলা সম্ভব। চকচকে গ্লাসে ঢেকে মৃত্যুকূপ বানিয়ে রাখা সম্ভব। আরো কত কি যে সম্ভব, এই সব সম্ভবের দেশে; তা আর এই খারাপ মানুষের মুখে নাইবা শুনলেন। আপনাদের মন খারাপ হয়ে যাবে। আমার মত কেউ মনে কোনো কুচিন্তা ঠাঁই দেবেন না। আপনাদের মাথায় শুধু সুচিন্তা থাকুক, হৃদয় ভরা থাকুক ভালোবাসায়।

এইচআর/এমকেএইচ

আসলেই বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। এখানে ১৮ তলার অনুমতি নিয়ে ২৩ তলা ভবন বানিয়ে ফেলা সম্ভব। চকচকে গ্লাসে ঢেকে মৃত্যুকূপ বানিয়ে রাখা সম্ভব। আরো কত কি যে সম্ভব, এই সব সম্ভবের দেশে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।