নদী দখলবাজরা জঙ্গির চেয়েও শক্তিমান?
নদী উদ্ধার তথা দখলমুক্ত করার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে বানচাল চেষ্টার হোতারা কি অপ্রতিরোধ্য? জঙ্গিদের চেয়েও শক্তিধর? কিছু ঘটনা দৃষ্টে সামনে আসছে প্রশ্নগুলো। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও নদীদূষণ বা দখল বন্ধের কঠোর নির্দেশনা এসেছে বেশ ক’বার। এতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো তৎপরতাও দেখা গেছে। অভিযানসহ কিছু পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু কিছু দূর এগুনোর পর কেন তা আবার ঝিমিয়ে পড়ে। কেন আবার বাড়তে থাকে নদী দখল ও দূষণের ভয়াবহতা?
খরস্রোতা নদীগুলোতে এখন স্রোতের বদলে ধু ধু বালুচর। বর্ষায় এসব নদীর পানিতে ভেসে যায় বাড়িঘর । এই ভূ-খণ্ডে এক সময় বহমান চার সহস্র নদ-নদী বয়ে যেত। বর্তমানে নদীর সংখ্যা এবং বহু নদীর অবস্থান বিলুপ্তপ্রায়। এ সংক্রান্ত সংখ্যাগত তথ্য দুর্বল।
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের তথ্য হচ্ছে: গত ৪৮ বছরে প্রায় অর্ধেক নদী শুকিয়ে মরে গেছে। সরকারি তথ্যমতে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। বর্তমানে তা নেমেছে ৪০৫ এ। পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর হিসাবে কোনো রকমে টিকে থাকা নদীর সংখ্যা ৪৩০। অবশ্য বেসরকারি তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০। গবেষকরা বলছেন, প্রতি বছর গড়ে ১০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ মরুর দেশে পরিণত হতে ততো সময় লাগবে না। এ ভয়াবহতা আগামী কয়েক দশক নাগাদ নদীশূন্য হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ৪০ বছর আগে দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ থাকলেও বর্তমানে তা কমে ছয় হাজার কিলোমিটারে ঠেকেছে। পাল্লা দিয়ে কমছে নদীর গভীরতা। বিষয়গুলো নদী ঘিরে গড়ে ওঠা জনজীবনের জন্য হুমকির। কারোই অজানা নয়, একে একে মৃতপ্রায় নদীমাতৃক বাংলাদেশের একসময়ের খরস্রোতা নদীগুলো।
নদীগুলো একদিকে ক্রমাগত সঙ্কীর্ণ হয়ে প্রবহমানতা হারাচ্ছে। আরেকদিকে, শিল্প বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। দূষণে-দখলে নদীগুলোর অহর্নিশ কান্না আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করলেও এর প্রতিকারের প্রশ্নে আমরা নীরবতাই পালন করে গেছি। শুধু নদী নয়, ঢাকা শহরের ভেতরের খালগুলোর অবস্থাও করুণ। দখলবাজরা অনেক খালকে নিরুদ্দেশ করে দিয়েছে।
কেউ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, কেউ প্রশাসনের সহযোগিতায়, কেউ বা অর্থবিত্তের ঝন্ঝনাতিতে নদী দখল করে বাণিজ্যিক আবাসন গড়ে তুলেছেন। শুধু নদ-নদী কেন খাল-বিলও দখল হয়ে উষ্ণ মরুর দিকে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। নদী দখল, নদী দূষণের জেরে জলবায়ুতে পরিবর্তন আসছে দ্রুত। বাড়ছে তাপমাত্রা। এ বাস্তবতায় আমাদের সুস্থ জীবনব্যবস্থার স্বার্থে নদীগুলোকে সচল রাখতেই হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের প্রতি কলকারখানায় বর্জ্য নিষ্কাশন ও ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আহ্বান অত্যন্ত সময়োপযোগী। কলকারখানাগুলো ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনে আগ্রহী না হলে নদী দখলমুক্ত হলেও, কোনো না কোনোভাবে এসব বর্জ্য নদী ও জলাশয়ে গিয়ে পড়বে। অর্থাৎ দূষণ চলতেই থাকবে।
রাজধানী ঢাকাঘেঁষা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগেরও দশা তুলনামূলক বেশি খারাপ। এক সময় বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে শুরু হয়েছিল ঢাকার নগরায়ণ। এখন সেই নগরায়ণই যেন মেরে ফেলছে বুড়িগঙ্গাকে। ২২৭টি সংযোগ খাল ছিল এ বুড়িগঙ্গায়। এগুলোর বেশিরভাগেরই অস্তিত্ব নেই। প্রভাবশালীরা শুধু বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, মসজিদ তৈরির নামেও দখল করেছে এসব খাল।
নদী দখল ও দূষণের পেছনে বেশির ভাগ ভূমিকা ক্ষমতাসীনদের। আবার নদীর পরিবেশ রক্ষায় দান, অনুদান, ঋণ হাতিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও তারাই আগুয়ান। অভিযান বানচালের সঙ্গে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে বুড়িগঙ্গার তলদেশ পরিষ্কার, দুই তীরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান কিংবা বর্জ্যব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপনের মতো বিভিন্ন উদ্যোগও থমকে গেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের নদী সুরক্ষাকেন্দ্রিক বিশেষ টাস্কফোর্সের সুপারিশ ও পরামর্শ।
ঢাকাসহ বাংলাদেশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে আদালত থেকে বার বার নির্দেশনা এসেছে। মাঝেমধ্যেই নদীর ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে। কিন্তু এর সুফল আসার আগেই শক্তি জুগিয়ে কোমর বেঁধে নামে দখলবাজরা। এবার প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পর বাংলাদেশের নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করার রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া বেশ জোরদার।
এরইমধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ বেশকিছু নদী আংশিক দখলমুক্ত করা গেছে। উদ্যোগটি মানুষকে আশাবাদী করেছে। দেশের নদী রক্ষা এবং নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা বরাবরই অগ্রণী এবং অকৃত্রিম। পরিবেশবাদী বেশকিছু সংগঠনও নদী দখল ও দূষণ নিয়ে আন্দোলনে বেশ লড়াকু।
আইন অনুযায়ী নদীর জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এ ব্যাপারে রয়েছে উচ্চ আদালতের রায় নির্দেশনা। হাইকোর্টের সাম্প্রতিক এক রায়ে তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে। একই রায়ে তুরাগ দখলকারীদের ৩০ দিনের মধ্যে তাদের সব স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা জোরালো হওয়ায় প্রশাসনও নড়েচড়ে বসেছে। উচ্ছেদ অভিযানের পর সেসব জায়গায় আবারও নদী দখল রোধে বেশ কিছু স্থায়ী উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছু নদীতে শুরু হয়েছে খনন কার্যক্রম।
যে কোনো সুস্থ মানুষের জন্যই এটি সুসংবাদ। নদীর পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর একনিষ্ঠতাও উল্লেখ করার মতো। কোনো মহলের কাছে মাথা নত না করার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছেন, অল্প দিনের মধ্যেই এর প্রতিফলন মিলবে। কিন্তু দখলদাররা সেই মাত্রায় উদগ্রীব নয়। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর মনোভাব , সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীর দৃঢ়তার পরও তাদের উদগ্রীব না হওয়ার রহস্যটা কোথায়?
সরকার বা দলের কোনো মহল এই চক্রকে অ্যাসেট ভাবলে মহাভুল হবে। এরা কোনোভাবেই অ্যাসেট নয়। লায়াবিলিটি। সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কিছু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গড়ে উঠেছে, যারা কারো কথাই মানতে চায় না। এমন কি মানছে না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও।
এদের রুখতে না পারলে শেখ হাসিনার কষ্টার্জিত সব অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে বলে শঙ্কা নাসিমের। তিনি সংসদে বলেছেন, ‘হঠাৎ এত বেশি আওয়ামী লীগ দেখে ভয় হয়। '৭৫ এর আগেও অনেক আওয়ামী লীগ দেখেছি। ১৫ আগস্টের পর সেই চেনা মানুষগুলো হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের ঘরে বাতি জ্বালানোর লোকও পাওয়া যায়নি। ওয়ান-ইলেভেনের পরেও অনেককে রাতারাতি বদলে যেতে দেখেছেন বলে মন্তব্য করেন নাসিম।
মনে করা হতে পারে মন্ত্রীত্ব খোয়া গেলে উচিৎ কথা বলার সঙ্গে আমরা পরিচিত। মন্ত্রীত্ব বহাল থাকলে এ ধরনের কথা বের হয় না। নাসিমের ওজারতি না হারালে হয়তো তিনিও উপরোক্ত কথা বলতেন না। এমন উপলব্ধিও হতো না। কিন্তু, তার কথা বা বার্তাগুলো কি অপ্রাসঙ্গিক বা ফেলনা? আমলযোগ্য নয়?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম