বিএনপি নামক দলটা এখন লন্ডনভিত্তিক দলে পরিণত হতে যাচ্ছে

অঘোর মন্ডল
অঘোর মন্ডল অঘোর মন্ডল , এডিটর, দীপ্ত টিভি
প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ২৪ মার্চ ২০১৯

বিংশ আর একবিশ শতাব্দি মিলে বাংলাদেশের বয়স হতে যাচ্ছে আটচল্লিশ বছর। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের পাতা উল্টালে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে; এখানে রাজনৈতিক ভারসাম্যের অভাব বেশিরভাগ সময় জুড়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী কিংবা তারও আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আগে সেই খারাপ স্মৃতির ধুলো উড়ছে দেশের রাজনীতির বাতাসে।

মোটা দাগে বলতে হবে, সেটা আমাদের রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোর শুধুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তার কারণে। বিরোধী দল বিরোধী দলের আসনে বসতে হীনম্মন্যতায় ভোগে। আর ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলকে পরিসর দিতে দ্বিধান্বিত থাকে। এরকম একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের রাজনীতি। এটা অস্থির সময় আর ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির চিত্র। যা একটা উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না। রাজনৈতিক দল আর রাজনীতিবিদদের কাছে সাধারণ মানুষেরও সেটা কাম্য নয়।

কিন্তু দিনে দিনে সেই অপ্রত্যাশিত রাজনীতির চেহারাটাই প্রকট হয়ে উঠছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান কেন্দ্র হবে জাতীয় সংসদ। কিন্তু প্রথম অধিবেশন শেষ হওয়ার পর সেই প্রত্যাশা হোঁচট খেয়েছে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জায়গা নিলো মহাজোটের অংশীদার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। মানুষের মনে সংশয় দানা বাঁধলো জাতীয় পার্টি কী সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে পারবে? সেই সংশয় দূর হওয়ার মধ্যে বক্তব্য তারা রাখতে পেরেছেন তেমন দাবি করা যাচ্ছে না। তবে এখনও অনেক সময় আছে; তাই চূড়ান্তভাবে আশাহত হওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আশাবাদী-ই বা হবেন কীভাবে!

বিরোধী দল যে নিজেদের ঘরের বিরোধ মেটাতে পারছে না! রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ভিন্নমত থাকতে পারে। থাকাটা স্বাভাবিক। সেটাকেও একভাবে বলা যেতে পারে দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা। আর সেই চর্চা থাকলে অনেক মানুষের অনেক মত মিলে যা দাঁড়াবে সেটাই হবে দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু জাতীয় পার্টি এমন একটা দল যার সব ক্ষমতা এককেন্দ্রিক।

অর্থাৎ; প্রেসিডেন্ট কেন্দ্রিক। আরো পরিষ্কার করে বললে বলতে হবে; এরশাদ কেন্দ্রিক। এই ভদ্রলোক আবার কখন কি বলেন তার ঠিক ঠিকানা নেই। নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি নিজেই আস্থা রাখতে পারেন না। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার মানসিক শক্তি তাঁর আছে কী না তা নিয়েও বার দুয়েক ভাবতে হবে। সকাল-বিকাল এক একজনকে এক এক পদের দায়িত্ব দেন। আবার কখন কাকে পদ থেকে সরিয়ে দেন তার ধারণা পাওয়া কঠিন। এবং তাঁর সেইসব সিদ্ধান্তের দূরদর্শীতা, যৌক্তিকতা না খোঁজাই ভাল। কারণ, খুঁজতে গেলে উত্তর হিসেবে পাওয়া যাবে একটা গোঁজামিল।

দিন দুয়েক আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নিজের ক্ষমতাবলে দলের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তাঁর ছোট ভাই সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের-কে। তবে এখনও জিএম কাদের জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা। সেই পদে তাঁকে রাখা হবে কী না বা তিনি থাকবেন কী না তা নিয়েও রয়েছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। সব মিলিয়ে চিত্রটা পরিষ্কার; জাতীয় পার্টিতে বিবোধের সাইরেন বাজছে!

আবার ভাঙনের সংকেতও পাচ্ছেন অনেকে। এরকম একটা ভঙ্গুর বিরোধী দল দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের কতোটা উন্নয়ন সম্ভব তাও বড় এক প্রশ্ন। সংসদে রিবোধী দলের কণ্ঠস্বর যদি জোরালো না হয়; তাহলে সেটা সরকারের জন্যও শুভ কিছু বয়ে আনে না। মহাজোটের অংশীদার হিসেবে বাকি যে সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং সংসদে এসেছেন তাদেরও মন ভাল আছে বলে মনে হয় না। কারণ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচন করলেও সরকারের তাদের কোন প্রতিনিধি নেই।

সরকারটা আওয়ামী লীগের। সহজ সমীকরণে বলতে হবে; ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, তরিকত ফেডারেশন তারা বিরোধী দলেরই অংশ। কিন্তু তাদের সেই বিরোধী কণ্ঠস্বরও খুব জোরালো ভাবে শোনা যায় না। জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের থেকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী এসেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মুহাম্মদ মুনসুর। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন করে গোটা সাতেক আসন পেলেও সুলতান ছাড়া তাদের বাকি সদস্যরা শপথ নেননি। সংসদেও যাননি।

সুলতান মুনসুর অবশ্য সংসদে গিয়ে বিরোধী দলের আসনেই বসেছেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আর্দশে বিশ্বাসী সুলতান মুনসুর টুঙ্গিপাড়ায় জাতির ‘পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছেন; ‘তিনি আওয়ামী লীগে ছিলেন। এবং আছেন।’ তাহলে সংসদে বিরোধী দলের কণ্ঠস্বর আরো ক্ষীণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। এই দায়টা অবশ্য বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। কারণ, নির্বাচনে অংশ নিলেন। কয়েকজন জয়ী হলেন। কিন্তু শপথ নিবেন না। সংসদে যাবেন না। তাহলে তারা কী কোনভাবে ক্ষমতায় যাবেন সেই আশায় বসে থাকবেন! নাকি ভাবছেন বাংলাদেশের জনগণ তাদের কোলে করে নিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন!

সংসদে নেই। রাজপথে নেই। দলের দুয়েকজন নেতা মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় আছেন। তাও কথা বলতে হলে ইংল্যান্ডের স্যাটেলাইটে ধরা দিয়ে আসতে হয়! অর্থাৎ, বিএনপি নামক দলটা এখন লন্ডনভিত্তিক এক দলে পরিণত হতে যাচ্ছে। যে কারণে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা আছে। প্রকাশ্যে সেটা না বললেও প্রকারন্তরে অনেকেই সেটা স্বীকার করে নিচ্ছেন।

বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবীরাও উপলব্ধি করতে পারছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু দল যারা পরিচালানা করছেন বা আগামীতে করবেন তারা যদি বুঝে না বোঝার ভাণ করেন, সেটা শুধু বিএনপি নয় দেশের গণতন্ত্রের জন্যও খুব ভাল কিছু নয়। রাজনীতি, গণতন্ত্র , দল,সরকার সব জায়গায় ভারসাম্য দরকার। তা না থাকা হচ্ছে বিপদের সাইরেন বেজে ওঠার আগমুহূর্ত। যা কারও কাম্য নয়।

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট এবং কলাম লেখক।

এইচআর/এমএস

‘রাজনীতি, গণতন্ত্র , দল,সরকার সব জায়গায় ভারসাম্য দরকার। তা না থাকা হচ্ছে বিপদের সাইরেন বেজে ওঠার আগমুহূর্ত। যা কারও কাম্য নয়।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।