ভেসে যাবে ছাত্র-শিক্ষক বন্ধন?

রাজীব কুমার দাশ
রাজীব কুমার দাশ রাজীব কুমার দাশ , পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ
প্রকাশিত: ০৩:৩৬ পিএম, ০৩ মার্চ ২০১৯

মানব সভ্যতা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ; গুরু শিষ্য বহুমাত্রিক মিথস্ক্রিয়া পরম্পরা রসায়নে, আমরা আধুনিক সভ্যতা ধারণ করে চলেছি। পরম্পরাক্রম বন্ধনে শ্রদ্ধা,প্রগাঢ়তা এবং মমতা না থাকলে আমরা এখনো সে প্রস্তর যুগের বৈতরণী হয়তোবা পাড়ি দিতে পারতামনা! গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মহান ত্যাগী শিষ্যের নাম প্লেটো।

প্লেটো তাঁর শিক্ষক সক্রেটিস এর অনৈতিক মৃত্যু তাঁর জীবনে প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, মমতা, ত্যাগে রচনা করেন, "ডায়ালগ"এবং" রিপাবলিক" গ্রন্থের মতো অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ। যে গ্রন্থের মাধ্যমে শিষ্য প্লেটো তাঁর শিক্ষাগুরু সক্রেটিস কে বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসেন।

আসলে, এ সৃজনে প্রমাণ করে,ছাত্র-শিক্ষকের পরস্পরের মিথক্রিয়া বদলে দিতে পারে,সমাজ,রাষ্ট্র,জীবনবোধ ও দর্শন। আমার আজ লেখার উপজীব্য বিষয়-

"শিক্ষকের দাঁত ভেঙে দিলো ছাত্র! আমি শিক্ষা বিভাগের, কিংবা রাষ্ট্রের কোনো নীতি নির্ধারক নই। রাষ্ট্রের একজন যৎসামান্য সেবক, আমার এসব বিষয়ে চিন্তা করা একপ্রকার বাতুলতা বৈকি! আসলে ছাত্র -শিক্ষক সম্পর্ক পরম শ্রদ্ধা, মমতামাখা এক অদৃশ্য আত্মদর্শনের নীল সুতোর টানে গাঁথা। মায়ের কোল পেরিয়ে, নিষ্পাপ শিশু প্রবেশ করেন-"জীবন জাগরণের উদ্ভাসিত" পবিত্র শিক্ষার আলোক ধারায়। শিক্ষকের প্রথম দিনের পরম মমতা, অনুরাগে হাতের পবিত্র আঙ্গুল স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে ছাত্র/ছাত্রীর শিক্ষণ শুরু হয়।

স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ধারাপাত, ইংরেজি বর্ণমালা,বাল্যশিক্ষায় থিতু হলে আস্তে আস্তে শিক্ষাগুরু নিজের কষ্টার্জিত বিদ্যা বিলিয়ে দিয়ে ধন্য হন! গর্ব করেন। সন্তানসম ছাত্রের মনোযোগ বাড়াতে বিদ্যাচর্চায় অনেক সময় দেরি হলে বাসায় খালি বাজারে ফেরেন।

এক সময়ে শিক্ষাগুরুর চশমার লেন্সের দৃষ্টি পুরুত্ব বেড়ে চলে। শরীরটা আগের মতো সায় দেয় না,মাঝবয়সী সময় হয়ে পড়ে বড়োই অপাঙক্তেয়? যে ছাত্রদের নিয়ে একদিন স্বপ্নের পসরা সাজাতেন! একজন প্লেটো, এরিস্টটল, বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন দেখতেন, সে ছাত্র-ছাত্রীরা পরিবার,অভিভাবক,পরিবেশ,সমাজ,কু-সংসর্গের আস্কারা অতিরিক্ত আদর প্রভাবের কারণে এখন ছন্নছাড়া। ভার্চুয়াল আকাশ সংস্কতির কু-প্রভাবে বয়ঃসন্ধিকাল আর শিষ্যদের পেরোনো হয় না।

মাতা -পিতা সম শিক্ষকেরা হাজারো চেষ্টা করেও পাঠ আদায়ে ব্যর্থ! হাজারো ছুতো! এলিবাই? ছাত্রটি পড়াশোনার বদলে হয়ে পড়ে রোমিও। অভিভাবকের নিকট হতে পগারপার রপ্ত করা,দামি মোবাইল টাকা পয়সা নিয়ে উচ্ছন্ন প্রথায় শরীরে উল্কি করে,দামি সিগারেট ধরে। হাতে চুড়ি, ভয়ংকর মার্কা হেয়ার কাট, অন্যছাত্রদের লোভে ভয়ে বাগে এনে দল ভারি করে। পড়াশোনা না করে, ভালো ছাত্রদের পরীক্ষা হলে খারাপ শব্দদূষণে তটস্থ রেখে দেখে লেখা অভ্যাসে পরিণত করে।

একটা সময় ভালো শিক্ষকরা রোমিও মার্কা কথিত ছাত্রদের চরম শত্রু হয়ে পড়লো! নীতিবান শিক্ষকবৃন্দ অবাধ্য ছাত্রদের শাসন করার জন্য চেষ্টা করলো? গুণধর অবাধ্য ছাত্ররা সাড়ম্বরে চিৎকার করে বললো,"আপনাদের কোনো অধিকার নেই মারার! আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।" আমরা থানা পুলিশ করবো।

ছাত্রদের বাজখাঁই চিৎকারে শিক্ষক মশাই চুপসে গেলেন? শিক্ষক মশাই জীবনের কোনো হিসাব-ই মেলাতে পারেন না। শুধু ভাবেন নির্বাক মৌনতায়। এরই মধ্যে আদরের ছাত্রটি "গুরুমারা শিষ্য" বিদ্যা অর্জন করে নিলেন। বইয়ের ব্যাগে আস্তে আস্তে দখল করে নিল, ছোরা, চাকু, ন্যাসাগু, ক্রিকেট ষ্ট্যাম্প, নাইলন দড়ি, সিগারেট, দিয়াশলাই আরো কতো কি? ইভটিজারে স্নেহময় বোকা ছাত্রটি দক্ষ হলো, শিক্ষক নস্যি! দলবেঁধে বয়ঃসন্ধি আকাশ সংস্কৃতিতে উপভোগ। স্কুলের ছাত্রীদের প্রতি লোপুপ ঈগল দৃষ্টি?? শিক্ষক মশাই প্রমাদ গুণলেন-

এতো অধঃপতন! তাঁর ছাত্রের? না শিক্ষক সাহেব একটু প্রতিবাদ করলেন; উনি গুণধর ছাত্রকে ছাত্রীদের ইভটিজিং না করার ধমক দিলেন ইঁচড়ে পাকা ছাত্রের ইগোতে লাগলো! ব্যস্ রোমিও হবার সুযোগ পেয়ে, গুণধর ছাত্রটি বুকে প্রচণ্ড সাহস,হাতে বল নিয়ে এক ঘুষিতে একেবারে খাঁটি"গুরু মারা শিষ্য"হয়ে গেলো!

শিক্ষা গুরু তাঁর মুখে হাত দিয়ে দেখে,তাঁর সামনের দুটি দাঁত শিষ্য (ছাত্র) প্রতিদান হিসেবে নিয়েছে। কি ভয়ংকর দৃশ্য!! একেবারে নায়ক শাহরুখ খাঁন স্টাইলে খলনায়ক অমরেশ পুরীর সিনেমার মারামারি দৃশ্যকেও হার মানিয়েছে? শিক্ষক মশাই, তাঁর স্নেহের গুণধর ছাত্রকে কি বলে আশীষ দিয়েছেন? আমার জানা না থাকলে ও হয়তোবা, একজন অমরেশপুরী হবার আশীষ দিয়েছেন নিশ্চয়ই।

আসলে দিনে দিনে এক ক্ষয়িষ্ণু বৈশ্বিক নির্লজ্জ সমাজ ব্যবস্থাপনায় আমরা অন্ধকারে মানবসত্তাকে বিকিয়ে দিচ্ছি? কখনো শিক্ষক, কখনো ছাত্র হারাতে চলেছেন,তাঁদের জৌলুস মহাকাব্যিক Teacher ও student সম্পর্কের ধারা।

আবহমানকাল হতে আসা আমাদের এ ধারাকে সচল রাখতে ব্যক্তি,পরিবার,সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্রদের তপস্যা অধ্যয়ন এর বাইরে কিছু হতে পারেনা। তাদের মনের অবগুণ্ঠনে যতোক্ষণ লোভ, ভোগের ঘুমন্ত দৈত্য জাগবেনা,তারা অবশ্যই student থাকবে।

শিক্ষকতা মহান পেশা। আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি,আমার প্রিয় শিক্ষকদের। ভোগবাদী চিন্তন,চরম স্বার্থান্ধ শিক্ষণ,বীক্ষণ,বাণিজ্যিক ভাবধারা আমার শিক্ষকদের মধ্যে পাইনি, দেখিনি। আমার শিক্ষকরা অনেক দূর পথ সাইকেলে চেপে ভোরবেলা ভাত তরকারি নিয়ে যথাসময় স্কুলে আসতেন, কোনো ছাত্র ভাত না খেলে বিরতি সময়ে খাইয়ে দিতেন। নিজে আধাপেট খেয়ে হাসতেন। Teacher শব্দের একরত্তিও এদিক সেদিক করেন নি। আবার শাসনেও ছাড় দেননি। অভিভাবক স্কুলে এসে বার বার বলতেন- "সন্তানের শাসনের ভার শিক্ষকের"।

আজ আমাদের দরকার-"শিক্ষকের মর্যাদায় "বাদশাহ আলমগীর ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের প্রধান শিক্ষক বরাবর লেখা চিঠি অভিভাবকের। কমিউনিটি সংস্কারক ও সফলতার নেপথ্যের বুনিয়াদ আত্মদর্শনের বহুমাত্রিক ধারায়, জনবান্ধব পুলিশিং ব্যক্তিত্ব পুলিশ সুপার, গাজীপুর শামসুন্নাহার পিপিএম (বার) তাঁর মননশক্তি জাগরণ করে, আগামীর মানবীয় সাম্যবোধ ভাবধারায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত গড়ে তুলেছেন সুদৃঢ়তায়।

স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সমাজকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন,মানবীয় শিক্ষণ বলয়। যে বলয় হবে, মাদক, বাল্যবিবাহ, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এককাট্টা বলয়। যে বলয়ে নিশ্চিত হবে, শ্রদ্ধা, মমতায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, আক্ষরিক অর্থেই হবে নিরাপদ শিক্ষণ। পথচলায় একবিংশ ও ভবিষ্যত দ্বাবিংশ শতাব্দীর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন দৃঢ় ছাত্র-শিক্ষক বন্ধন। যে বন্ধনে তৈরি হবে,নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, সক্রেটিস, প্লেটো,এরিস্টটল,ইবনেসিনা,নিউটন,ডারউইন।

আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর প্রত্যেকের এক বা একের অধিক জীবনের গল্প আছে। যে গল্প সংগ্রাম,বেদনা,যন্ত্রণার । যে গল্পগুলো প্রকাশ হয় না কখনো। "একটুখানি দয়া সে যন্ত্রণার ক্ষতে ঢেলে দিতে পারে,আনন্দের প্রলেপ। এতে হয়তো আমরা রাতারাতি জগত বদলাতে পারবো না। কিন্তু সেই মানুষটির জগত আমূল বদলে যাবে।

ছাত্র -শিক্ষকের দায়িত্ব, কর্তব্যের সেতুবন্ধন পরম্পরায় আত্মিক বন্ধনে আমরা আবার ফিরিয়ে আনবো আমাদের গর্বের সোনালী বন্ধন। যে বন্ধনে রচিত হবে, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের পথচলায় দিকদর্শন।

লেখক : পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।

এইচআর/পিআর

ছাত্র -শিক্ষকের দায়িত্ব, কর্তব্যের সেতুবন্ধন পরম্পরায় আত্মিক বন্ধনে আমরা আবার ফিরিয়ে আনবো আমাদের গর্বের সোনালী বন্ধন। যে বন্ধনে রচিত হবে, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের পথচলায় দিকদর্শন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।