বিমান: বাংলাদেশের নাট-বল্টুতে হ্যাঁচকা টান

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

খরস্রোতা হয়ে বিশাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে এক ইস্যু তলিয়ে যাচ্ছে আরেক ইস্যুতে। চট্টগ্রামে বিমান ছিনতাই চেষ্টার অভিযোগে একজন নিহতের ঘটনা খরার টান ফেলেছে ঢাকার চকবাজার ট্র্যাজেডিতে। হতাহতের সংখ্যা কখনো কখনো একটি ট্র্যাজেডিকে আরেকটির চেয়ে গৌণ করে দিচ্ছে।

একজন মানুষের মৃত্যুও যে বেদনার- তা আমল পাচ্ছে না লাশ বা ভয়াবহতা বিচারে। সংখ্যা বিচারে চকবাজারে আগুনে পুড়ে ৭০জন নিহতের ঘটনা নিমতলীর তুলনায় ছোট। কারণ, নিমতলিতে প্রাণ গেছে ১১৯ জনের। তাজরীনে ১১২। আর রানা প্লাজায় হাজার ছাড়িয়ে পৌঁছেছে ১২০০-তে। সেই তুলনায় বিমান ছিনতাই চেষ্টার অভিযোগে মাত্র একজন নিহতের ঘটনা তেমন ঘটনার মধ্যেই পড়ে না। কিন্তু এ ঘটনাটিকে এমন সরল অংকে ফেলা খুব সহজ না-ও হতে পারে।

হত্যার যাবতীয় আয়োজন রেখে মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়ার এ প্রবণতা চলতে থাকলে একসময় হাজার কেন লাখো হত্যাও মামুলি হয়ে যাবে। দু’চারটা মিতু, তনু, সাগর-রুনি ঘটনা হিসেবেই গণ্য হবে না। থাকবে না এ ধরনের হত্যা বা মৃত্যুর নিউজ ভ্যালুও। মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভ্যালু পাবে নিহতের পরিবারকে লাখ-হাজার অংকের ক্ষতিপূরণের খবর। অথবা নিহতের প্রেম-মহব্বতসহ বিভিন্ন বিষয়াদি। ইস্যুর তোড়ে ইস্যু হারানোর এমন অভিষেক আমাদেরকে কোন তলানিতে নিয়ে ঠেকাচ্ছে? বিশেষ করে হত্যা-খুন, ধর্ষণ চিনা বাদামের মতো তুড়িতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। নাথিং হয়ে যাচ্ছে সব ঘটনাই।

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত যুবকের হাতে থাকা অস্ত্রটি খেলনা পিস্তল বলে জানিয়েছে পুলিশ। বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীও রাতে এক টেলিভিশনে বলেছেন, ওই পিস্তলটি ছিল খেলনা। অথচ এর আগে, বলা হয়েছে ওই ব্যক্তি কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে। কমান্ডো অভিযানের সময় গোলাগুলিও হয়েছে। তা’হলে সেই পিস্তলটি কোথায়? এ যুবক কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাৎক্ষণিক তা-ও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। বলেছেন, চিত্রনায়িকা সিমলার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ওই যুবক এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। অথচ তখনও তিনি যুবকের নাম জানেন না। কিন্তু নায়িকার নাম জানেন। যদিও যাত্রী তালিকায় যুবকের সব তথ্যই থাকার কথা।

যুবকটির নায়িকার সঙ্গে সম্পর্ক বা প্রেমে ব্যর্থতাকে যেন একটি জুতসই মওকা হিসেবে মিলেছে। বিমান প্রতিমন্ত্রী সেখানেই থামেননি। পরে আবার ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, সেটি খেলনা পিস্তলও ছিল না। প্লাস্টিক ধরনের কিছু একটা দিয়ে সে ভয় দেখিয়েছিল। জাসদ একাংশের নেতা মাইনউদ্দীন খান বাদলের ওই বিমানের যাত্রী হিসেবে ঘটনার বিবরণ দিয়ে তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রচার হয়েছে গণমাধ্যমে। পরদিন বলেছেন, তিনি আসলে ওই বিমানে ছিলেন না। কী দাঁড়ালো অর্থটা?

নানামুখী এমন কথার খই ফোটানো কেন জরুরি হয়ে পড়লো? সাংঘর্ষিক, হাস্যকর কথার কচলানিতে ঘটনা আড়ালের এ বাস্তবতা হয়তো বিমান ছিনতাই চেষ্টা ও একজন নিহতের ঘটনাও মাটিচাপা পড়ে যাবে। ইস্যু বরবাদের চেষ্টা সফল হবে। আল্লাহ না করুক, বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা সফল হলেও চাপা দেওয়ার মতো ধামা মিলবে। সেই সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে অহরহ। কিন্তু, বিমান আর আট-দশটার মতো বিষয় নয়। এর সঙ্গে একটা দেশের পরিচয়-অস্তিত্ব সম্পৃক্ত। তা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বকেও নাড়া দিয়েছে। সামনে এসেছে অনেক প্রশ্ন। আসল বা নকল যে পিস্তলই হোক তা নিয়ে একটা লোক বিমানে চড়ে বসলো? ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তা’হলে কী দাঁড়ায়? বিশ্ববাসী কী জানলো? এ ক্ষেত্রে যা-তা বাঙাল বুঝ দেয়ার সুযোগ আছে?

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তার শাসনকালের শেষদিকে আসামের বন্যা সচক্ষে হেলিকপ্টার নিয়ে ঘুরে দেখেছিলেন। তা নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতায় লিখেছিলেন: ‘দোহাই ইন্দিরা, বলে ফেলবেন না ‘বাহ কি সুন্দর’।
নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা মোকাবেলা বা উৎরানোর ব্যাপারে ‘বাহ কি সুন্দর’ বলার চর্চা ভর করেছে আমাদের মধ্যেও। নানা ছুতা বা রেশ টেনে এনে মূল ঘটনাকে আড়াল বা বেমালুম করার কাজটি চলছে বিমান নিয়েও। এ ছাড়া বিমানবিষয়ক ঘটনায় কারণে-অকারণে প্রধানমন্ত্রীকে প্যাঁচানো হচ্ছে। এ ঘটনার দিন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ওঠানামা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীও। আবার ছিনতাই চেষ্টায় লিপ্ত পলাশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন বলেও প্রচার হয়েছে।

এর আগে, গতবছর বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইটে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের নাট বল্টু খোলার খবর রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে বিমানের নাট-বল্টু ঢিলা হয়ে গিয়েছিল। তখন বিমানটিকে দ্রুত নামতে হয় তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশকাবাদের বিমানবন্দরে। সেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে মেরামতের পর প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বিমানটি যাত্রা করে বুদাপেস্টের উদ্দেশে। বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানকে বহনকারী বিমান এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ার নজির এটাই প্রথম। এ নিয়ে ক’দিন ব্যাপক তোলপাড় হয়। পরে প্রচার হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিমানকে ঢেলে সাজানোর চমৎকার খবর। ঢালা ও সাজানোর লক্ষ্যে বিমান মন্ত্রণালয়কে কিছু নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। বিমানের ১১ প্রকৌশলীকে আটক এবং জিজ্ঞাসাবাদসহ হুলস্থুল চলেছে। পরে আর কোনো ফলোআপ মেলেনি।

আরো কিছু ঘটনায়ও কিছুটা ইমেজ সংকটে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকায় ভিন্ন কিছু ক্রিয়া-কর্মও ঘটছে। মায়ের সামনে ডিবি পরিচয় দিয়ে অস্র দেখিয়ে বিমান বন্দরের মতো এলাকা থেকে ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়তি কিছু বার্তাও দেয়। বিমানবন্দর ঘিরে লাগেজ পার্টি, থাবা পার্টি, টানা পার্টির উপদ্রব অনেকদিনের। সদরঘাট, সায়েদাবাদ, কমলাপুরসহ স্টেশন-টার্মিনালগুলোর জন্য তা হজমযোগ্য হলেও কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ভয়ঙ্কর কলঙ্কের। অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অপচয়, স্বজনপ্রীতি, গাফিলতি ইত্যাদির কারণে বহুবার শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ বিমান।

ঢাকা থেকে সিলেটগামী বিমানের কলকাতা চলে যাওয়া বা সিলেট থেকে ঢাকামুখী বিমানের চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার ঘটনা হাস্যকর হলেও এগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়েছিল। ‘আকাশে এক টুকরো শান্তির নীড়’ শিরোনামের বাংলাদেশ বিমানের দুর্ঘটনা ও ব্যাপক প্রাণহানির ইতিহাসও রয়েছে। দুর্ঘটনায় দেশের প্রথম নারী পাইলট রোখসানা নিহতের ঘটনা সামলিয়েছে বাংলাদেশ। বলা হয়েছিল, বিশ্বের বড় বড় দেশেও বিমান দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু এবার যে ইস্যু ও রকমফের ঘটলো তার জের একটু বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফ্লাইটটির গন্তব্য ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই। এই ফ্লাইটে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল থেকেও যাত্রী নেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

শাহজালাল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দুর্বলতা পুরনো বদনাম হলেও অস্ত্র নিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে উঠে তা ছিনতাইয়ের চেষ্টা বাংলাদেশে এই প্রথম। পিস্তল কেন, নেইল কার্টার ধরনের কিছু রাখলেও ধরা পড়ার মতো ব্যবস্থা রয়েছে বিমানবন্দরে। কিভাবে বিমানবন্দরে এত সিসি ক্যামেরা, একাধিক স্ক্যানিং মেশিন এবং গোয়েন্দা নজরদারি ব্যর্থ হলো? এমন প্রশ্নের তোড়ে পুরো ঘটনাকেই উল্টে দিয়ে একবার বলা হচ্ছে, সেটি ছিল খেলনা পিস্তল। আবার বলা হচ্ছে, প্লাস্টিক ধরনের কিছু। এতো রংবেরংয়ের কথায় ল্যাঠা আরো জটিল হচ্ছে। তা’হলে গোলাগুলি হলো কিভাবে? কি দিয়ে? সেই পিস্তলটা কোথায়?

বাংলাদেশে বিমান ছিনতাই চেষ্টা প্রতিহতের চাঞ্চল্যকর খবরের সুবাদে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নামযুক্ত বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে তাজা হলো পুরনো প্রশ্ন ও অপবাদ। নিরাপত্তা ভেদ করে কারো অস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দরের ভেতর ঢোকাই নয়, একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে উঠতেও পেরেছে? বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোর কাছে এটি হট নিউজ। আর বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশের। গোটা বিশ্ব পেল বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি খারাপ বার্তা। এর আগে ২০১৬ সালে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যের সরাসরি মালবাহী বিমান বা কার্গো চলাচল বন্ধের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। সেটা কাটাতে পাক্কা দু’বছর বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া মানে তারা সারাজীবনের জন্য সন্তুষ্ট থাকবে- এমন নয়। পুরনো বিষয়ে এখন প্রশ্ন এসে যেতেও পারে। কারণ, এটা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে রয়েছে দেশের নাট-বল্টুর কিছু বিষয়আসয়ও।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকায় ভিন্ন কিছু ক্রিয়া-কর্মও ঘটছে। মায়ের সামনে ডিবি পরিচয় দিয়ে অস্র দেখিয়ে বিমান বন্দরের মতো এলাকা থেকে ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়তি কিছু বার্তাও দেয়। বিমানবন্দর ঘিরে লাগেজ পার্টি, থাবা পার্টি, টানা পার্টির উপদ্রব অনেকদিনের। সদরঘাট, সায়েদাবাদ, কমলাপুরসহ স্টেশন-টার্মিনালগুলোর জন্য তা হজমযোগ্য হলেও কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ভয়ঙ্কর কলঙ্কের। অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অপচয়, স্বজনপ্রীতি, গাফিলতি ইত্যাদির কারণে বহুবার শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ বিমান।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।