আমি বাংলায় কথা বলি

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৮:১৮ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

যে ভাষা প্রবাহিত হয় পদ্মা-মেঘনা নদীর অববাহিকায়, যে ভাষায় কথা বলে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপের মানুষ, যে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন বীর সন্তানেরা, যে ভাষায় এই বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ রূপের প্রকাশ আমি সেই বাংলায় কথা বলি।

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবস। আমার কাছে ফেব্রুয়ারি মানেই মাতৃভাষার মাস, বইমেলার মাস। ফাল্গুন মানেই ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হওয়া, ফাল্গুন মানেই মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ে ভালোবাসার কুসুম ফোটানো।

আমার বাংলা ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে শত শত পুঁথির ভিড়ে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এই আবিষ্কার বদলে দেয় বাংলাভাষার ইতিহাস। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বইটি হলো চর্যাপদ বা চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় যা বাংলাভাষার আদি নিদর্শন। এই বইতে ৪৭ জন পদকর্তার রচনা রয়েছে যাদের অধিকাংশই ছিলেন প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন জনপদের অধিবাসী।

বাংলা ভাষার জন্ম কবে এ নিয়ে পণ্ডিতদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ভাষার জন্ম তো আর মানুষের জন্মের মতো দিন ক্ষণ মেপে হয় না। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে ৬৫০ থেকে ৯শ’ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষার জন্ম। ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠির অন্তর্গত হলো বাংলাভাষা। গৌড়ী প্রাকৃত থেকে গৌড়ী অপভ্রংশের জন্ম। গৌড়ী অপভ্রংশ থেকে আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বিহারী, প্রাচীন উড়িয়া, বঙ্গ-কামরূপী ভাষার জন্ম। আর বঙ্গ কামরূপী থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে অসমিয়া ও বাংলা ভাষার জন্ম। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে প্রচলিত কথ্য ভাষা থেকে বাংলা, অসমিয়া ও উড়িয়া ভাষার জন্ম হয়েছে। তাই বাঙালির পাশাপাশি অসমিয়া ও উড়িষ্যাবাসীরাও চর্যাপদকে নিজের বলে দাবি করে। তবে ভুসুকু বাঙালি, বঙ্গালি ভইলিসহ বিভিন্ন শব্দ থেকে মনে করা হয় চর্যাপদের উপর বাংলার দাবিই সবচেয়ে বড়।

দেশ বা জাতি হিসেবে বঙ্গের উল্লেখ অবশ্য পাওয়া গেছে অনেক প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে। ঋগ্বেদে, মহাভারতে ও অন্যান্য সাহিত্যে বঙ্গ দেশের উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গের রাজা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। গ্রিক ঐতিহাসিকদের লেখায় গঙ্গা হৃদি বা গঙ্গা হৃদয় নামে যে দেশের উল্লেখ পাওয়া যায় তা প্রাচীন বঙ্গ বা গৌড়। প্রাচীনকালে বাঙালির বসবাস ছিল বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, সমতট, পুণ্ড্র, হরিকেল, শ্রীহট্ট, কামরূপ ইত্যাদি অঞ্চলে যা বর্তমানের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বলে ধরে নেওয়া যায় এবং তা ত্রিপুরা ও আসামের সংলগ্ন অঞ্চল। ঋগ্বেদে বঙ্গ জাতির উল্লেখ রযেছে যারা আর্যদের যজ্ঞের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি।

ঐতরেয় আরণ্যক-এ সর্বপ্রথম মগধের সঙ্গে বঙ্গ নামের জনগোষ্ঠির উল্লেখ পাওয়া যায। সে হিসেবে বলা যায় গত তিন চার হাজার বছর ধরেই এ অঞ্চলে বাঙালি জাতির বসবাস ছিল যাদের মুখের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা রুপে একটি সুনিদিষ্ট রূপ পেয়েছে।

বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপির উদ্ভবও অনেক আগে।ব্রাহ্মী লিপি থেকে কুটিল লিপির উদ্ভব। আর কুটিল লিপি থেকে দশম বা একাদশ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন বাংলা লিপির উদ্ভব হয়। বলা যায় দশম শতকের শেষভাগেই মূল বাংলা বর্ণমালার জন্ম। এই বর্ণমালার নিদর্শন পাওয়া যায় প্রথম মহীপালের (৯৮০-১০৩৬) বাণগড়ের দানপত্রে। এই দানপত্রে আধুনিক বাংলা বর্ণমালার অ, উ, ক, খ,গ,চ,ঢ,ব,হ এবং জ বর্ণ দেখতে পাওয়া যায়। কম্বোজের রাজা নয়পালদেবের (১০৩৬-১০৫৩) দানপত্রেও বাংলা বর্ণমালার কয়েকটি বর্ণ দেখা যায়। দ্বাদশ শতকের শেষভাগে বাংলা বর্ণমালা প্রায় বর্তমানে প্রচলিত বর্ণমালার আকার ধারণ করে।

লক্ষণ সেনের আনুলিয়ার দানলিপি, ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরবনের দানলিপিতে বাংলা বর্ণমালার অনেক আধুনিক রূপ দেখা যায়। সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত বাংলা বর্ণমালার চেহারা প্রায় বর্তমানের মতোই ছিল। ১৭৭৮ সালে প্রথম ছাপার হরফে বাংলা বর্ণমালা প্রকাশিত হয়। প্রাচীন পুঁথির বাংলা অক্ষরের আদলে চার্লস উইলকিনস প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেন এবং হুগলিতে প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনগুলো বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য ও অনুবাদ সাহিত্যের অন্তর্গত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শ্রীকৃষ্ণবিজয়, গোবিন্দবিজয়, বিদ্যাসুন্দর, চৈতন্যমঙ্গল, ইউসুফ জুলেখা, সায়াত-নামা, পদ্মাবতী, গোরক্ষবিজয় ইত্যাদি হলো বাংলাভাষায় মধ্যযুগের সাহিত্যকীর্তির নিদর্শন।

অনেক পথ পার হয়ে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা আজ বর্তমান রূপ পেয়েছে। যে ভাষায় কান পাতলে শোনা যাবে নাথপন্থী সহজ সাধকদের সান্ধ্য ভাষা, মধ্যযুগের কবিদের কীর্তন, মঙ্গলগীত, পদ্মাবতীর আখ্যান, আরাকান রাজসভায় বাঙালি কবির বিজয়ের কাহিনী, ময়মনসিংহ গীতিকা, বিদ্যাসাগরীয় গদ্য, বঙ্কিমের উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব দর্শন, নজরুলের বিদ্রোহী সুর, লালনের মানবতাবাদ।

বাংলাভাষার উপরে বারে বারে আঘাত এসেছে। রাজপদলেহীরা সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজির দাপটে বাংলাভাষাকে অপাঙক্তেয় করতে চেয়েছে। কিন্তু এদেশের জনগণ পরম মমতায় তাকে বুকে তুলে নিয়েছে। পাকিস্তান আমলে উর্দুভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, বাঙালিকে হীনবল করতে ষড়যন্ত্র করেছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের পথ নির্মাণ করেছেন এদেশের ছাত্রজনতা ও বুদ্ধিজীবীরা। ভাষাশহীদরা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছেন বাংলাভাষার মর্যাদা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অধ্যাপক আবুল কাশেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন এর মতো পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাভাষার পক্ষে সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করেছেন।

শহীদুল্লাহ কায়সার, মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ, নাদেরা বেগম, আবদুল মতিন, ওলি আহাদ, আহমদ রফিক, রফিকুল ইসলাম, গাজীউল হকের মতো সেসময়ের বামপন্থী ছাত্রনেতাসহ সর্বস্তরের ছাত্ররা ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রাণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ প্রমুখ।

ভাষা আন্দোলনে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন সেকথা আজও সঠিকভাবে জানা যায় না। কারণ অনেক শহীদের মৃতদেহ পুলিশ গুম করে ফেলেছিল। সেসময় তথ্য প্রযুক্তিও এত উন্নত ছিল না। ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা নিখোঁজ হয়েছিলেন তাদের পরিচয় আর কখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। এমনকি কতজন নিখোঁজ ছিলেন সে তথ্যটিও সঠিকভাবে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

একুশের দিন পুলিশের গুলিবর্ষণে যে শহীদদের পরিচয় মোটামুটিভাবে পাওয়া গেছে তারা হলেন আবুল বরকত, রফিকুদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার,সালাহউদ্দীন, এবং নাম না জানা এক কিশোর। পরদিন ২২ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হন শফিউর রহমান, আউয়াল এবং অহিউল্লাহ। অনেক ভাষা সৈনিকই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন যে, ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি অনেক শহীদের মরদেহ পুলিশ গুম করে ফেলেছিল। এই ঘটনাকে ভিত্তি করেই শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরী তার কবর নাটকে নাম না জানা শহীদের কথা তুলে ধরেন। যাদের মৃতদেহ উঠে এসেছিল কবর থেকে। ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদের পূর্ণ পরিচয় না পাওয়া গেলেও তাঁরা ভাষা শহীদ হিসেবে জাতির ইতিহাসে চিরদিনই পরম শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন।

বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়।

২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোতে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হতে থাকে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাদেশ। ২০১১ সালের মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

আমাদের মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের পিছনে প্রবাসী বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের প্রধান ভূমিকা রয়েছে। ইউনেস্কোর জরিপে বাংলাভাষা বিশ্বের মধুরতম ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ভাষার সুরঝংকারে যে মিশে আছে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের অসীম ভালোবাসা ও ত্যাগের ইতিহাস। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এখন প্রয়োজন শুদ্ধ বানান, প্রমিত উচ্চারণের চর্চা। প্রয়োজন সঠিক ইতিহাসকে জানা। অপসংস্কৃতিকে বর্জন করে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির চর্চা। তাহলেই আমরা ভাষা শহীদ ও ভাষাসৈনিকদের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখাতে পারব। বছরে একটি মাত্র দিনে নয়, শহীদ মিনারকে হৃদয়ে ও চেতনায় ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবেসে বিশ্বসভায় বাংলার আসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।

এইচআর/জেআইএম

বছরে একটি মাত্র দিনে নয়, শহীদ মিনারকে হৃদয়ে ও চেতনায় ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবেসে বিশ্বসভায় বাংলার আসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।