সরকারকে জনগণের পক্ষের হয়েই থাকতে হবে
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মূল সংকটটি আসলে কি তা খুঁজে বের করার দায় এদেশের শিক্ষিত, সুশীল, শিক্ষক-গবেষকদের হলেও এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য খুব কমই শোনা যায়। বরং আমরা প্রতিদিনকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তর্ক বাঁধিয়ে ফেলি এবং শেষ পর্যন্ত সমস্যা সমস্যার জায়গাতেই থেকে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ যতোই সামনের দিকে এগুচ্ছে ততোই এই প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে উঠছে যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে এগুনোর পথে সবচেয়ে বড় বাধাটি আসলে কি?
বহুজনে বহুধা বিভক্ত উত্তর দেবেন, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু গবেষকদের উচিত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা। তবে যে যেরকম উত্তরই দেন না কেন, এগুলোর মধ্যে একটি উত্তর নিঃসন্দেহে ‘কমন’ থাকবে যে, এদেশের রাজনীতি ঠিক হলেই সব সমস্যার সমাধান মিলবে। বিষয়টি হয়তো ঠিক, হয়তো ঠিক নয়, কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে এবং হওয়া উচিতও।
মাত্রই যে সাধারণ নির্বাচনটি শেষ হলো এবং যেটি নিয়ে এখনও আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে, সেটিতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি পরম্পরা বা ইতিহাস রয়েছে, পৃথিবীর সকল দেশেই সেটা থাকে। আর সকল দেশেই একদা তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল এক সময় জনপ্রিয়তা হারিয়ে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনই একটি রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সেই তুমুল সময়ে দখলকার ব্রিটিশ চাতুর্যের ফসল মুসলিম লীগ। উপমহাদেশের দু’টি প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তিই কেবল নয়, বিদ্বেষ জিইয়ে রেখে ব্রিটিশ শাসনকে আরো পাকা-পোক্ত করার জন্য ‘আশরাফ মুসলিম’-এর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী ভারতীয় কংগ্রেস-এর সমান্তরাল যে রাজনৈতিক শক্তিটি রাজানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটিই মুসলিম লীগ।
শুরুটাই ছিল বিচ্ছিন্নবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অগণতান্ত্রিকতা, স্বার্থপরতা এবং সর্বোপরি দেশ-জাতি’র স্বার্থকে তুচ্ছ করে গোষ্ঠীস্বার্থ তথা নিজেদের প্রতিপত্তিকে আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং ‘কিংস পার্টি’ বা রাজার দল হিসেবে নিজেদের শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করা। প্রাথমিক ভাবে নিজেদের আলাদা ধর্ম-সম্প্রদায় হিসেবে দাবি করা হলেও শেষাবধি এই দাবি গিয়ে ঠেকে ভিন্ন জাতিসত্তায়। অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমান যে দু’টি আলাদা জাতিসত্তা সেটি প্রমাণের মতো ভয়ঙ্কর রাজনীতিতে নামে মুসলিম লীগ। এতে জাতীয় কংগ্রেসের কোনো দায় নেই, সে দাবি কেউ করবে না, কিন্তু একথা সত্য যে, মুসলিম লীগের সম্প্রদায়ভিত্তিক ধর্মীয় রাজনীতি উপমহাদেশে রক্তপাতকে উসকে দিয়েছিল।
পাকিস্তান ভাঙার দাবি যে অযৌক্তিক ছিল তা বহু গবেষক প্রমাণ করেছেন এবং এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষকে শক্তিহীন করা। ব্রিটিশ দখলদার সেটিই নিশ্চিত করেছে। নইলে এই ভারতবর্ষেও মানুষই আরব থেকে আসা ধর্মকে গ্রহণ করার পরও কী করে তারা কেবলমাত্র ধর্মের কারণেই আলাদা জাতি হয়ে যায় রাতারাতি সে প্রশ্নের উত্তরতো এখনও মেলেনি।
মজার ব্যাপার হলো, এই ঢাকা শহরেই মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল এবং ভারত-ভাঙার বীজও এই শহর থেকেই ছড়ানো শুরু হয়েছিল। কিন্তু উল্টো পঁচিশ বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তানই ভেঙে গেলো, তাও এই ঢাকা শহর থেকেই। বাংলাতেই প্রবাদ রয়েছে যে, “যে ভাবে সৃষ্টি সে ভাবেই লয়”।
অর্থাৎ যেভাবে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল মিথ্যাচার আর সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে বৈষম্যবাদের কারণে তেমনই পাকিস্তানও ভেঙেছিল ঠিক এসবের বিরুদ্ধে বাঙালির সম্মিলিত প্রতিবাদে। ভারতবর্ষ ভাঙার ইতিহাস থেকে যে রাজনৈতিক শিক্ষা মুসলিম লীগ গ্রহণ করেনি তার প্রমাণ হলো, বাংলাদেশ সৃষ্টির পথেও মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুসলিম লীগই।
বাঙালি যখন একটি অসাম্প্রদায়িক, ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনাবোধ নিয়ে পাকিস্তানের নিগড় থেকে বেরুনোর পথ খুঁজছে তখনও মুসলিম লীগ তাদের সেই শুরুর ধর্মভিত্তিক, কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে যখন বাঙালি জাতিবর্ণধর্ম নির্বিশেষে একটি স্বাধীনতাকামী শক্তিতে পরিণত হচ্ছে, তখনও মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার কথা বলছে, অজুহাত সেই দ্বি-জাতি তত্ত বা ধর্মীয় বিভেদ।
আরও মজার ব্যাপার হলো, একাত্তর সালে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পতনেও তারা এই শিক্ষা নেয়নি যে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ধর্মভিত্তিক, কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনীতি আর চলবে না, বাঙালি নতুন এক জাতীয়তাবাদের দিশা পেয়েছে।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই যে কেবল রাজনীতিকে উল্টে দেয়া যায় সেটা আবারও পঁচে যাওয়া মুসলিম লীগ ও স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের নতুন ও পুরোনো দোসররা প্রমাণ করলো ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে। এসব কথা পুরোনো শোনালেও এর চেয়ে বড় কোনো সত্যি এদেশের রাজনীতিতে নেই যে, বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি শুরু হয়ে একাত্তরে একটি স্বাধীন দেশ অর্জনে সমর্থ হয়, সেই রাজনীতির মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ১৯৭৫-এ।
এবং কারা ঘোরায়? সেই পুরোনো পাকিস্তানপন্থী, ধর্মভিত্তিক মুসলিম লীগের বুড়োরা এবং তাদের দোসর চীনপন্থী বামেরা। এই দু’য়ের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের ‘স্যুডো মিলিটারি’ ও ‘ব্যুরোক্রেসি’ ফলে বাংলাদেশে নতুন ‘কিংস পার্টির’ জন্ম হয়, যারা মূলতঃ ক্ষমতায়ই থাকতে চায় এবং সেটা যেভাবে সম্ভব। কখনও ক্ষমতায় থাকার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে যুদ্ধাপরাধী, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে বৈধতা দিয়ে তাদেরকে নিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা হয়, আবার কখনও সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়।
বেশিরভাগ সময়ই তারা সফল হয় এই প্রচেষ্টায়, যে বার হতে পারে না সেবার চেষ্টা হয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে কখনও জঙ্গী আমদানী করে, কখনও ধর্মীয় উসকানি দিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করে, কখনও বা ১৫ ই আগস্ট বা গ্রেনেড হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বাংলাদেশের সম্পদ লুটের কথাতো কোনো ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বছরের পর বছর বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি পরিচালনা করার জন্য অর্থ কোত্থেকে কীভাবে আসে সে প্রশ্ন এদেশের বিজ্ঞজনেরা কেন তোলেন না, সেও এক চরম বিস্ময়।
২০০৮ সালের পর থেকে এই রাজনীতির গতি বদলাতে শুরু করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে হত্যার পর সুস্থ-স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় বাংলাদেশ এখনও সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ করতে পেরেছে এরকম দাবি করার সুযোগ এখনও আসেনি। বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এক পথের শুরু হয়েছে, যদিও সে পথ সম্পূর্ণ মসৃণ বা নিষ্কলুষ সে দাবিও করার সুযোগ এখনও আসেনি। কিন্তু একথা সত্য যে, বাঙালির সামনে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে সেই পুরোনো সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে গঠিত রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে ত্যাগ করার এবং উপমহাদেশের তরঙ্গসংকুল রাজনৈতিক পথ মাড়িয়ে যে সকল রাজনৈতিক দল সব সময় জনগণের পাশে থেকেই রাজনীতি করেছে তাদেরকে বেছে নেওয়ার।
ভুল-ভ্রান্তি তাদেরও ছিল এবং আছে, কিন্তু একথাতো দিনের আলোর মতো সত্য যে, রাতারাতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে সৃষ্ট বলেই তারা জনগণের ভাষা কখনও বোঝেনি, কেবল তাদের রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে কিংবা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় ক্ষমতাকে ব্যবহারের পথ তৈরিকেই তারা এতোদিন রাজনীতি ভেবেছে বলে, প্রকৃত রাজনীতির পরীক্ষায় তারা বার বার ‘ফেইল’ করেছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও যে পরাজয়, সে পরাজয়ও আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগ-জাত রাজনৈতিক শক্তিকে বাঙালির অস্বীকার করার দিন। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বটে, সে জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক পক্ষই কমবেশি দায়ী। কিন্তু এর ভেতরও যে সত্য স্পষ্ট হয়েছে তাহলো, ক্ষমতার বলয়ে থেকে তৈরি হওয়া রাজনীতি, ভুল রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও বাংলাদেশ-বিরোধী রাজনীতির দিন এদেশে শেষ হয়েছে।
একই সঙ্গে এই নির্বাচন বিজয়ীদেরও এই বার্তা দিচ্ছে যে, জনগণ নির্বাচনী-অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়েছে, এর মানে এই নয় যে, জনবিরোধী সরকারকেও তারা মেনে নেবে। তাই যা কিছুই হোক না কেন, সরকারকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনগণের পক্ষের হয়েই থাকতে হবে। নাহলে পরিণতি ভালো হওয়ার কথা নয়।
ঢাকা ৪ ফেব্রুয়ারি, সোমবার ২০১৯
[email protected]
এইচআর/এমকেএইচ