আত্মহত্যা : দায়ী কে ব্যক্তি নাকি সমাজব্যবস্থা?
সকালে ঘুম থেকে যখন জেগে উঠি তখনই আমার মাথায় প্রথম যে সিগন্যালটি আসে তা হলো- হুররে আজকের দিনটাও বেঁচে আছি। হয়তো নাও বেঁচে থাকতে পারতাম! নিশ্বাসের কিইবা ভরসা আছে।
বেঁচে আছি , প্রিয়মানুষের সঙ্গলাভ করছি, দিনের রোদ গায়ে মাখছি, হয়তো দূষিত বাতাসে হেঁটে বেড়াচ্ছি,হন্য হয়ে ভেজাল নির্ভেজাল যাচাইবাছাই করে কবজি ডুবিয়ে কতই না পদ খাচ্ছি,বেশিরভাগ সময়ই দাপিয়ে বেড়াচ্ছি ,আবার হয়তো সামান্য অসুখে হচ্ছি কাবু,আবার উঠে দাঁড়াচ্ছি ,হচ্ছি নানা প্রতিযোগিতায় সামিল।
কখনও টাল সামলাতে পারছি আবার হয়তো পারছিনা। দুষ্টু মানুষগুলোর সাথে সবসময় পেরে ওঠা হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। চাচ্ছি তাদের থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখতেই। কিন্তু মানুষ তো তাইনা? পারছি কি নিজেকে নোংরা- দূষিত নষ্টভ্রষ্ট সব কাজ থেকে বিরত রাখতে? মাঝেমধ্যে পা পিছলে যাচ্ছি কি? নিজের চাওয়াপাওয়া পূরণের জন্য ,অন্যকে প্রতিযোগিতায় ডিঙ্গিয়ে যাওয়ায় জন্য মাঝেমধ্যে কতরকম ফন্দিফিকিরই না আটছি।
উপরে যা বললাম কেবলই নিজের উদাহরণ দিয়ে। আমি জানি আমার চারপাশের মানুষগুলোর জীবনাচারণ নিশ্চয় এর থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। আসলে এটাই বোধহয় জীবন। বেশির ভাগ মানুষই আমার মতো জীবনকে যেভাবে-যতভাবে পারা যায় উপভোগ করে যান। কিন্তু মাঝেমধ্যে কি এক আশ্চর্য দহনে কেউ কেউ নিজের অমূল্য জীবনকে নিজ হাতে শেষ করে দেয়। উত্তর মেলাতে পারিনা। তাদের বুকে কি তবে জ্বলছিল দাবানল?
এ পৃথিবীর কোন কিছুই কি তাদের সামান্যটুকু শান্তি দিতে পারেনি? মনে প্রশ্ন জাগে- কতশত বার চিন্তা করেছিলেন তারা নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিতে? জীবন কি হাতের মোয়া? ‘জীবন এতো ছোটো ক্যানে ’-এর উত্তর মেলাতে মেলাতেই তো সব ফুরিয়ে যায়। সেখানে নিজেকে নিজেই নৃশংসভাবে পীড়ন করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিবো? মাথায় কিছু খেলেনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী কে কেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হতে পারার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে? তবে কি বলতে হবে সে কেবল পেয়েছে পুঁথিগত শিক্ষা? কোন কিছু প্রাপ্য হলে তা না পেলে খারাপ লাগা খুবই সত্য। কিন্তু তা কি জীবনের সমমান? বিশ্ববিদ্যালয় তো বিদ্যালয় নয়- শুধু কয়েকটি প্রশ্ন মুখস্থ করে/শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়া কেবল। বিশ্ববিদ্যালয় তো নানা জ্ঞান আহরণের জায়গা।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চিন্তা আদানপ্রদানের জায়গা। তবে কি আজকাল মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজেকে শুধু ভালো চাকুরির জন্যই নিজেদের প্রস্তুত করছেন? জীবন-জগত -চাওয়াপাওয়ার পরিধি-জয় পরাজয় নিয়ে ধারনা নিচ্ছে না? পরীক্ষায় ফুলমার্কস পাওয়ার মানে কি জীবনের পরীক্ষাতেও জয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী কি শিখেনি অনিয়ম দেখলেই প্রতিবাদ করতে হবে? প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো পারে সমাজের অনিয়ম দূর করতে? নাকি আমরা শিখছি কেবল সব পরিস্থিতিতে মাথানিচু করে চারপাশের সবার সাথে সমঝোতা করে মানিয়ে চলতে?
কিভাবে মেনে নেই একেকজন মেধাবীর আত্মহনন? যেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেশের নানা সংকটে অতীতে পথে নেমে এসে দেশ/তাদের অধিকার আদায় করে নিয়েছে। যেসব মেধাবী নিজেদের শেষ করে দিয়েছে অবলীলায় তারা কি দেখেনি পথের পাশে ছেঁড়া ময়লা কাপড়ে সে শিশুটিকে- যে শুয়ে আছে বেওয়ারিশ কোন প্রাণীর সাথে?
সে কি কখনও দেখিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কোন রোগীকে- যে হাজারও সুই কাঁচির খোঁচা খেয়েও বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে? আজকালকার মেধাবীরা কি বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে চারপাশকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে কেবল? স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া কোনও মৃত্যুই কাম্য নয়।
সাধারণ-অসাধারণ-মেধাবী- খেটেখাওয়া মানুষ গুলোর আত্মহত্যার কথা (তুচ্ছ প্রেমে ব্যর্থতা-পরকীয়া থেকে শুরু করে কোন কাঙ্খিত পদ না পাওয়া) পত্রিকার পাতায় যখন দেখি কেবলই মনে হয় এ মৃত্যুর পেছনে দায়ী কে? সে নিজেই নাকি সমাজ ব্যবস্থা? ইটপাথরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে হাজারটা পাঠ্যপুস্তকের ফর্মুলা বোধহয় জীবনের আসল উদ্দেশ্যই আমাদের শেখাতে পারছে না।
সময় হয়েছে আজ গভীরভাবে আত্মহনন নিয়ে ভাবার। দিন দিন তা বাড়ছেই কেবল। মনোচিকিৎসাবিদ- রাষ্ট্র-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ-পরিবার বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিন। এটি যেন পত্রিকায় কেবল একদিনের শিরোনামে বন্দি না হয়। নতুবা হারাবো হয়তো আরো অনেক হীরের টুকরো জীবন।
এইচআর/এমএস