মানবপ্রেমী এক সাংবাদিকের নাম মানিক সাহা

আশীষ কুমার দে
আশীষ কুমার দে আশীষ কুমার দে , সিনিয়র সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্তমত প্রকাশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন আজ ১৫ জানুয়ারি। মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অকুতোভয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক সাহার মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের অদূরে ছোট মির্জাপুর এলাকায় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের বর্বরোচিত বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই জীবনপ্রদীপ নিভে যায় তাঁর।

মৃত্যুকালে দৈনিক সংবাদ ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এবং বিবিসি বাংলার খণ্ডকালীন সংবাদদাতা ছিলেন তিনি। এর আগে খুলনা প্রেসক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মানবপ্রেমী এই কলমসৈনিক ও কণ্ঠযোদ্ধার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও শত-সহস্র রক্তিম অভিবাদন।

ছাত্রজীবনে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে ছাত্ররাজনীতি এবং কর্মজীবনের শুরুতে খুলনায় সাংবাদিকতা করার সুবাদে দীর্ঘ দেড়যুগেরও বেশি সময় মানিক সাহার সরাসরি সান্নিধ্য ও স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৯৯৯ সালে খুলনা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমালেও সেই স্নেহ-ভালোবাসা থেকে কখনও বঞ্চিত হইনি। তাই এ লেখার উদ্দেশ্যই হলো তাঁকে নিয়ে সামান্য স্মৃতিচারণ করা, তাঁর সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের গণমাধ্যমকর্মীদেরকে কিছু ধারণা দেয়া।

মানিক সাহা কী শুধুই একজন সাংবাদিক ছিলেন? তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের সাংবাদিক সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিন্দা ও প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছিল, তা দেখে তখন অনেক সাধারণ মানুষ এমন প্রশ্নই তুলেছিলেন। না, তিনি শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না; তাঁর পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। মৃত্যুকালে মানিক সাহা একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক ছাড়াও বিশ্বনন্দিত মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, খুলনা চ্যাপ্টারের সভাপতি ছিলেন।

তবে তাঁর পরিচয় এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্ররাজনীতি থেকে মানবমুক্তির লড়াইয়ে দীক্ষিত মানিক সাহা নিজেকে বহুমুখি কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। সে কথা জানাতেই একটু পেছনে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ও ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এক দুঃসাহসিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল।

রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করা প্রতিক্রিয়াশীল অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত পোস্টার লাগাতে শুরু করেছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ছাত্র সংগঠনটি। একরাতে খুলনার সরকারি ব্রজলাল মহাবিদ্যালয় (বি এল কলেজ) চত্বরে সেই পোস্টার লাগানোর সময় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মানিক সাহাকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।

এরপর নির্মম দৈহিক নির্যাতন ছাড়াও সামরিক আদালতের বিচারে ২২ মাস কারাদণ্ড হয় তাঁর। জেলখানায় বসেই স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর আশির দশকে সামরিক-স্বৈরাচার এরশাদ আমলেও গ্রেপ্তার হয়ে আরেক দফা নির্মম নির্যাতন ও দীর্ঘ কারাবাসের শিকার হন তিনি।

Manik-Saha-1কিন্তু নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও মানবমুক্তির লড়াই থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মানিক সাহা। দারিদ্রকে পায়ে মাড়িয়ে স্নাতকোত্তর এবং আইন শাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেয়ে যান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদ ও খুলনা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ। কিন্তু আইন ব্যবসায় না গিয়ে সাধারণ মানুষের শোষণ-বঞ্চনার ও ন্যায্য অধিকারের কথা সর্বত্র তুলে ধরতে ঝুঁকিপূর্ণ ও অপেক্ষাকৃত কম উপার্জনের সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ দুই দশকের পেশাগত জীবনে তাঁর কলমে সেই অধিকারের কথাই বহুবার ফুটে উঠেছিল।

ফসলি জমিতে জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে লোনা পানিয়ে ঢুকিয়ে পরিবেশবিনাশী চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে সব সময়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। বিত্তবান ও প্রভাবশালী চিংড়িঘের মালিকদের প্রলোভন ও রক্তচক্ষু তাঁকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের পৈশাচিক নির্যাতনের কাহিনী বিবিসি রেডিওতে মানিক সাহার দরাজকণ্ঠে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে।

তাঁকে হত্যাও করা হয় সেই সরকারের আমলে। জনশ্রুতি আছে, তৎকালীন সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, খুলনার বিএনপি ও জামায়াতের তৎকালীন দুই সাংসদ, বাগেরহাটের বিএনপিদলীয় এক সাংসদ ও খুলনার জামায়াতপন্থী এক সাংবাদিক ছাড়াও খুলনা বিভাগের তৎকালীন এক মন্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মানিক সাহা তাঁর সতীর্থ সাংবাদিকদের প্রায়ই বলতেন, “মানুষ যখন নিপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত হয়ে পুলিশের কাছে যেয়েও ন্যায্য প্রতিকার পায় না, ন্যায় বিচারের আশায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে ব্যর্থ হয়, তখন সাংবাদিকরাই হয়ে ওঠেন তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। তাই সাংবাদিকদের সেভাবেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।”

হ্যাঁ, মানিক সাহা জীবদ্দশায় সেই দায়িত্বশীলতার পরিচয়ই দিয়ে গেছেন। এ কারণে সাংবাদিকতার গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর খুলনা ও যশোর অঞ্চলে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও শিশু সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি কমরেড রতন সেন পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক, উদীচীর খুলনা জেলা সংসদের সহসভাপতি, খেলাঘর-খুলনা জেলা কমিটির উপদেষ্টা, শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অরতীর্থ বিদ্যাপীঠের সহসভাপতি এবং খুলনার ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাউথ হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাডেমিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তাঁর হাতেগড়া অনেক সাংবাদিক এখন ঢাকা ও খুলনায় সুপ্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মানবমুক্তির লড়াইয়ে নিবেদিতপ্রাণ এই গুণী মানুষটিকে নৃশংসভাবে হত্যার ন্যায়বিচার পাননি তাঁর স্বজন, সহকর্মী ও সুহৃদরা। দীর্ঘ ১২ বছর পর ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর খুলনার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং জেলা ও দায়রা জজ এম এ রব হাওলাদার এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১১ জন আসামির ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুই জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।

পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্রে হত্যার পরিকল্পনাকারী, অর্থের যোগানদাতা, তাদের পৃষ্ঠপোষক ও ভাড়াটিয়া খুনিদের নাম ছিল না। যে কারণে প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার আড়ালে রয়ে গেছে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর চাপে পুলিশ স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে না পারায় আদালতে ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রয়াত মানিক দা’র উদ্দেশে এতোটুকুই বলতে চাই- কাপুরুষেরা তোমাকে হত্যা করলেও তোমার আদর্শকে নির্মূল করতে পারেনি। সাহসী ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাংবাদিকতা এবং মানবমুক্তির সংগ্রামে তুমি চিরদিন দিশারী রবে।

মৃত্যুঞ্জয়ী মানিক সাহা- তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, শত সহস্র রক্তিম অভিবাদন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী।

এইচআর/জেআইএম

কাপুরুষেরা তোমাকে হত্যা করলেও তোমার আদর্শকে নির্মূল করতে পারেনি। সাহসী ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাংবাদিকতা এবং মানবমুক্তির সংগ্রামে তুমি চিরদিন দিশারী রবে। মৃত্যুঞ্জয়ী মানিক সাহা- তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, শত সহস্র রক্তিম অভিবাদন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।