হাসিনা ম্যাজিক!
আমার এক বন্ধু কল্যাণপুরে থাকেন। তার এলাকাটি ঢাকা-১৪ আসনের মধ্যে পড়েছে। এমনিতে তিনি আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্খী। কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পর তার দেখি ভীষণ মন খারাপ। তার দাবি, ঢাকা-১৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আসলামুল হকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। তিনি জেনেশুনে এমন একজনকে ভোট দিতে চান না।
আবার আওয়ামী লীগকে ভোট না দেয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। প্রতিদিন তার দ্বিধা। একবার ভাবেন ভোট দিতে যাবেন, একবার ভাবেন যাবেন না। কিন্তু ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার ভাবনায়ও বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। তিনি ভোট দিতেই চান। আর খালি আফসোস করেন, কেন তিনি ধানমন্ডি বা খিলগাঁওয়ের ভোটার হলেন না। তাহলে তো কোনো দ্বিধা ছাড়াই মনের আনন্দে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারতেন।
ভোটের আগের দিন পর্যন্ত দ্বিধা-সংশয় ছিল। আগের বিকেলে হঠাৎ সব দ্বিধা ছেড়ে তিনি বললেন, আমি কাল সকালে ভোট দিতে যাবো এবং নিশ্চিন্তে নৌকায় ভোট দেবো। কারণ আমি আসলামকে নয়, আমি শেখ হাসিনাকে ভোট দেবো। নৌকায় ভোট দিলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন।
শুধু আমার এই বন্ধু নয়, দেশের অনেক মানুষকেই এমন দ্বিধায় পড়তে হয়েছিল। টেকনাফ, টাঙ্গাইল বা নোয়াখালীর মানুষ নিশ্চয়ই মনের আনন্দে অভিযুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীর বউ বা খুনের দায়ে জেলে থাকা ছেলের বাবা বা যুদ্ধাপরাধীকে নৌকায় ভোট দেয়নি। কিন্তু সবাই সব দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছেন শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে।
দেশি-বিদেশী একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ব্যক্তি শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা দলকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। আমি অনেক দিন ধরেই বলছিলাম, দেশে এখন সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচন হলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জিতবে কিনা জানি না, তবে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির নির্বাচন হলে শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে জিতবেন।
আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে। তবে এ জয়ও যতটা না আওয়ামী লীগের, তারচেয়ে অনেক বেশি শেখ হাসিনার। একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের পরিকল্পনা, কৌশল প্রণয়ন এবং তা কার্যকর- পুরোটাই শেখ হাসিনা করেছেন। তাকে সামনে রেখেই দল নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে।
শেখ হাসিনাই যে তাদের শেষ ভরসা, এটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভালো করেই জানেন। তাই এই শেষ ভরসার ওপর সব দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা নিশ্চিন্তে অপকর্ম করে বেড়ান। গত নির্বাচনে নানান জরিপে অন্তত ১০০ জনবিচ্ছিন্ন এমপির তালিকা করা হয়েছিল। তাদের মনোনয়ন না দেয়ার প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমানুর রহমান খান রানা আর আবদুর রহমান বদি ছাড়া কেউ অপকর্মের কারণে মনোনয়নবঞ্চিত হননি।
তাও রানার বদলে তার বাবা, বদির বদলে তার বউ মনোনয়ন পেয়েছেন। তার মানে মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোনো পানিশমেন্ট-রিওয়ার্ড ব্যবস্থা ছিল না। পাঁচ বছর ধরে নানান অপকর্ম, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, জনগণের কাছে না যাওয়া, দুর্ব্যবহার করা, দলে গ্রুপিং করা, কর্মীদের মূল্যায়ন না করা, টাকা নিয়ে চাকরি না দেয়া, দুর্নীতি- ইত্যাদি করেও দলের মনোনয়ন পাওয়া যায়, এমপি হওয়া যায়।
এটা জেনে গেলে সেই লোকগুলোকে থামানো মুশকিল। সামনে তারা আরো দানব হয়ে উঠবে, যা দল ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। নানা জরিপের ভিত্তিতে নেতিবাচক ভাবমূর্তির চিহ্নিত ১০০ জনকে মনোনয়ন না দিলে, সারাদেশে একটা দারুণ বার্তা যেতো- অপকর্ম করে আওয়ামী লীগে পার পাওয়া যায় না। মনোনয়ন পেতে হলে ভালো কাজ করতে হবে, নইলে খবর আছে। ভালো কাজ করুক আর খারাপ, একই ব্যক্তি আজীবন মনোনয়ন পাবেন, এটাই যদি রীতি হয়, তাহলে দলের অন্যরা কাজ করবে কোন ভরসায়।
মনোনয়ন পেতে হলে ভালো কাজ করতে হবে, জনগণের কাছে যেতে হবে; এই বার্তাটা পরিষ্কার করে দিলে; দলের নেতাদের মধ্যে ভালো কাজের একটা প্রতিযোগিতা হতে পারে। গত নির্বাচনে পারা না গেলেও ভবিষ্যতের জন্য এই বার্তাটা জরুরি। যে দলে তেল আর ঘি এক দরে বিকোয়, সেটি ভালো দল নয়।
এবারের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, এবারের নির্বাচন আগের মত হবে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা তা কানে তোলেননি। তারা অপেক্ষায় ছিলেন, শেখ হাসিনা কোনো না কোনো ম্যাজিকে তাদের আবার ক্ষমতায় এনে দেবেন। হয়েছেও তাই। এটা যদি সবাই বুঝে যান, তাদের কিছু করতে হবে না, শেখ হাসিনাই তাদের ক্ষমতায় এনে দেবেন; তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তা দলের জন্য ক্ষতিকর।
আচ্ছা এই যে 'হাসিনা ম্যাজিক' বলা হচ্ছে, এটা কী? 'হাসিনা ম্যাজিক' হলেন শেখ হাসিনা নিজেই। ’৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ৬ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবেই উত্তরাধিকারসূত্রে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন। তারপর ৩৭ বছরের এক অসাধারণ জার্নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা, এই পরিচয় অবশ্যই শেখ হাসিনার জন্য সবচেয়ে বেশি গৌরবের। কিন্তু শেখ হাসিনা এখন নিজের যোগ্যতায়ই দলের সভানেত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী। শুধু দেশ বা দল নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও শেখ হাসিনা এখন একক অনন্য নাম। এ অর্জন শেখ হাসিনার একার, তাঁর ৩৭ বছরের লড়াইয়ের ফল।
ড. সলিমুল্লাহ খান নির্বাচনের পর এক টক শো'তে বলেছিলেন, এবারের নির্বাচন আসলে শেখ হাসিনার পক্ষে-বিপক্ষে গণভোট হয়েছে। আর সেই গণভোটে শেখ হাসিনা বিপুল রায় পেয়েছেন। অবশ্য বিরোধী দল নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনেছে। আগের রাতেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা, বিএনপির এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়া, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে না দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদিও বিরোধী দল অভিযোগের পক্ষে জোরালো প্রমাণ দিতে পারেনি এখনও, তবুও আমি ধরে নিচ্ছি তাদের অভিযোগগুলো সত্যি। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা কেমন ছিল? অভিযোগগুলো সত্যি না হলেই কি বিএনপি জিতে যেতো? আওয়ামী লীগের স্পষ্ট অবস্থান ছিল, দল জিতলে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু শেখ হাসিনার ঝলমলে নেতৃত্বের বিপরীতে ঐক্যফ্রন্ট কাউকে দাঁড় করাতে পারেনি।
ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল নির্বাচনেই অংশ নেননি। ঐক্যফ্রন্ট জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাও তারা পরিষ্কার করেনি। তাদের লুকোছাপা দেখে মনে হয়েছে, ঐক্যফ্রন্ট জিতলে তারেক রহমানই প্রধানমন্ত্রী হবেন। কারণ দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে, সবকিছু ছিল তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণে। এখন আপনারাই বলুন, নৌকা জিতলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী; ধানের শীষ জিতলে তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী; এই সমীকরণে আপনি কাকে ভোট দেবেন? আমার তো ধারণা ড. কামাল, মির্জা ফখরুলসহ অনেকেই গোপনে শেখ হাসিনার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। যতই স্বৈরাচার বলুন আর একচ্ছত্র নেতৃত্ব বলুন; প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কে আছেন বাংলাদেশে?
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি প্রিয় স্লোগান 'যতদিন শেখ হাসিনার হাতে দেশ, ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ।' আমরাও চাই পথ না হারাক বাংলাদেশ। উন্নয়নের পথে আরো গতি পাক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই পথ ফিরে পাক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, আইনের শাসনের বাংলাদেশ, মানবাধিকারের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
এইচআর/জেআইএম