সেলিম আল দীন: স্বভূমির বরপুত্র নাট্যকার ও শিল্পতাত্ত্বিক
রবীন্দ্রোত্তরকালের অকাল প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন। বিচিত্র রূপ ও রীতির নাটকের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর শিল্পসাধনার অন্তর্নিহিত মৌল সুর একটি সুনির্দিষ্ট শিল্পাদর্শ ও শিল্পতাত্ত্বিক পটভূমির উপর স্থাপিত। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শেকড়ের সন্ধান ছিল তাঁর অভিপ্রায়। তাই তাঁর শিল্পভাবনায় আমরা স্বদেশজাত চৈতন্যকে দেখি আর দেখি সেই চৈতন্যের এক বিশ্বমুখীন অভিযাত্রা।
মূলত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে নব নব প্রেরণা আর সৃষ্টিশীল ধ্যান-নিমগ্নতা নিয়ে সেলিম আল দীন নাটকের মতো যৌথ এক শিল্পমাধ্যমে আত্মপ্রকাশে ব্রতী হয়ে উঠেছিলেন। জীবনের স্বল্প পরমায়ুর মধ্যেই তিনি প্রকাশিত হয়ে উঠেছিলেন অনন্য দীপ্তিতে। আজ ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ নাট্যাচার্যের একাদশ প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বপরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের শিল্পসাহিত্যে নানা মতবাদপুষ্ট ও স্বল্পস্থায়ী শিল্প আন্দোলনের বিপরীতে উপনিবেশমুক্ত বিশেষত তৃতীয়বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের সৃজনক্ষম শিল্পীদের চেতনায় নাগরিকবোধ ও বিশ্বাসে ‘স্বদেশ’, ‘স্বভূমি’ আর এই ‘স্বভূমিজ’ বাস্তবতার অন্বেষা ব্যাপক জায়গা অর্জন করে। সেই চেতনার স্বরূপ আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তিলাভের মাত্র চার বছরের মধ্যে আবিষ্কারে সক্ষম হয়ে উঠি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ তৎপরবর্তীকালের সকল আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে শিল্পের নানা শাখায় উক্ত চেতনার বিস্তার ঘটে। ভাষা আন্দোলন আমাদের উল্লিখিত চেতনাবোধকে আরো শাণিত করে তোলে। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বজাতীয় সংস্কার-সংস্কৃতির প্রতি এই চেতনাবোধই উল্লিখিত প্রত্যয়সমূহের প্রতি অর্থাৎ ‘স্বদেশ’ ও ‘স্বভূমির’ প্রতি আরো গভীরভাবে দৃষ্টি ফেরানোর তাগিদে উদ্বুদ্ধ করে।
তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি অপশাসনের তথা নয়া-ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত অল্পসংখ্যক বাঙালির মতো সেলিমও মঞ্চের মাধ্যমে খুঁজেছিলেন সহস্রবর্ষের চিরায়ত বাঙলাকে- আর চিরায়ত বাঙলার ভূমি এবং ভূমিজ বাস্তবতার স্বরূপ। তাই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে একদা বলেছিলেন : ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমকালীন থিয়েটারের একটা বড় অংশ শিল্পের নিত্যকে আপন ইতিহাসের সহজ পরিক্রমের ধারায় গ্রহণ করে নি। শিল্পরচনার নিগূঢ় তাগিদের চেয়ে চলমান আহ্বানের দিকে তার উৎকর্ণ যাত্রা, প্রথার ছাঁচে এক প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণে আশ্চর্যজনক তৃপ্তি। ফলে শিকড়ের চেয়ে শাখার দিকে আমাদের মনোযোগ বেশি।’
বিশ্বের কোনো অঞ্চলের পাঠকই সেলিম আল দীন পাঠে তাঁকে উৎকেন্দ্রিক নাট্যকার বলার স্পর্ধা দেখাতে পাবেন না। কারণ তাঁর রচনার থরে থরে বিন্যস্ত বাঙালির স্বদেশ-ভূগোল আর এর অধিবাসী ও আদিবাসী সকলের নৃতাত্ত্বিক আচরণের ক্রমবিবর্তন মূর্তমান চলচ্ছবির আদলেই জীবন্ত। উপরন্তু, তাঁর রচনায় মূর্তমান হয়ে ওঠে ঋতু-কাল-আবহাওয়া নির্বিশেষে আকাশের রঙ আর বাতাসের ঘূর্ণায়মানতার সঙ্গে এই ভূমিজ প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্যের বিপরীতে জনপদের প্রাচীন এবং অনন্ত বিশ্বাসও।
তাঁর অনুসন্ধিৎসায় তিনি উদ্ধার করে আনেন এ অঞ্চলের হাজার বছরের প্রত্মমানবের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতা এবং মগ্নচৈতন্যের শৈল্পিক ফিউশনের আশ্রয়ে তিনি সৃজন করে চলেন এই ভূমিজাত মানবের শিল্পসাধনার কল্যাণে নিবেদিত মহান এক শিল্পতত্ত্ব। যা ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব¡’ অভিধায় চিহ্নিত।
স্বদেশ ও স্বভূমিই সেলিমের দাঁড়াবার স্থান, সৃজনশীলভাবনা ও সৃষ্টিশীলতায় আত্মপ্রতিষ্ঠার স্থান। পদতলে স্থিত এই ভূমি তাঁকে উদ্বেলিত করে, মাতৃমমতায় মথিত করে। অথচ আমাদের এই ভূমি তথা বৃহত্তর অর্থে প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যবাসীরা ক্রমাগত বিবেচনা করে আসছিল পেশা হিসেবে। আবার এই প্রাচ্যভূমি আত্মপ্রকাশেও ‘অপরাগ’ বলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বিশ্বব্যাপী যে প্রচারণা চালিয়েছেন তার বিপরীত মেরুতেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কীভাবে? তিনি তাঁর নিজস্ব শিল্পভুবন স্বভূমে স্থিতকরণের মাধ্যমে প্রাচ্যকে প্রকাশ করে তুলেছেন। প্রাচ্য যে আপনার মধ্য দিয়ে আপনিই স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠতে পারে সে ঘোষণাও তিনি বজ্রকণ্ঠে দিয়েছেন।
সে প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচ্যের বিশিষ্ট অভিনয়রীতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে। অভিনয় শিল্পভাবনায় সেলিম প্রাচ্যভূমিকেই শাশ্বত ভেবেছেন- শাশ্বত ভেবেছেন প্রাচ্যের স্বতন্ত্র ও শক্তিধর প্রকাশশৈলীকেও। তাঁর ভাষায় : ‘পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অভিনয় একেবারে বিপরীতমুখা। বাস্তবের ক্রিয়া-কাহিনিকে সেখানে পাওয়া যাবে চরিত্রের ক্রিয়ার ধারাবাহিকতা হিসাবে। পক্ষান্তরে প্রাচ্যের অভিনয় হচ্ছে বর্ণনাকে ক্রিয়াতে রূপান্তর। অর্থাৎ বর্ণনাত্মক অভিনয়ের যে সকল রীতিতে কথক বা গায়েন আছে- তার কাজ কথাকে এমন একটা চলমানতা দান করা যা অনুকরণ সঞ্জাত ক্রিয়া নয়―যা সুর ও ছন্দের অবলম্বনে ব্যাখ্যাধর্মী।’
সেলিমের নাট্যচিন্তা সম্পর্কে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন : ‘সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন, কিন্তু বাংলা ভাষার সৃষ্টিবুদ্ধি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই। বাঙলায় তিনি লেখেন কারণে বাংলার মানুষের অস্তিত্ব এবং জগৎ-বোধ, যাপিত জীবনের স্বপ্ন ও যন্ত্রণা তাঁর বিষয়- তা বিশ্বের সকল মানুষেরই মানচিত্র হয়ে ওঠে বটে।’
সেলিমের ক্ষোভ ছিল আমরা আমাদের মতো করে স্ব-ভূমি বা স্ব-ভূমিজ বস্তুনিচয় মায় শিল্প সাহিত্যের রসাস্বাদন করতে পারি না বলে; ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে পাশ্চাত্যের শিল্পতত্ত্বকে অজর-অমর-অক্ষয় এবং অভ্রান্ত হিসেবে গলাধকরণ করেছি বলে। পাশ্চাত্য-প্রণীত শিল্পতত্ত্বের আলোকে আমাদের স্ব-ভূমিজ শিল্প-সাহিত্যের বিশ্লেষণ-বিচারেই বেশি আগ্রহী বলেও তাঁর আক্ষেপ ছিল। বাঙলা শিল্পসাহিত্যের নন্দনশৈলীর বিচারে পাশ্চাত্য শিল্পতত্ত্বের অন্ধ-অনুসরণকে দৃঢ়তার সাথেই তিনি ভ্রান্ত বলে ঘোষণার মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়নেও আমরা যে সেই অপকৃষ্ট ও ভ্রান্ত মানদণ্ডই ব্যবহার করে আসছি সে সম্পর্কেও সেলিম আমাদের সচেতন করে দেন। তিনি বলেন : ‘রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্য ধারার সাঙ্কেতিক রূপকতায় বিচার করতে গিয়ে এমন এক অনাকাঙ্খিত স্থলে উপনীত হয়েছি যে- তা থেকে না সাঙ্কেতিকতা না রূপকতা বা রবীন্দ্রশিল্পতত্ত্ব কোনোটাকে- কোনো মতেই আর নিজেদের মতো করে বোঝা গেল না।’
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা নন্দনতাত্ত্বিক সঙ্কটের সূচনা উপনিবেশের হাত ধরেই ঘটেছিল। ফলে বাংলা নাটকের আঙ্গিক সঙ্কটের শুরু তখন থেকেই। অর্থাৎ তখন থেকেই আমরা উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলাম যে, বাংলা নাটকের রূপ-রীতি-আঙ্গিক কখনোই ইউরোপীয় থিয়েটারের আদলে নির্মিত হতে পারে না। আবার এ ভাবনাও অমূলক নয় যে, আমরা ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত বিবেচনায় নিজেদের অবলোকনের ভ্রান্ত এক পন্থা অবলম্বন করেছিলাম।
এতদ্বিষয়ে সমালোচক বলেন: ‘সেলিম আল দীন পাশ্চাত্য নাট্যের যে গড়ন তা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন, তার লক্ষণ সব নাটকেই রয়েছে- যদিও তার ধরন হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, পাশ্চাত্য নাটকে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চরম মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানোর প্রায় কোনো বিকল্প নেই। সেই পরিচিত গড়ন কিন্তু সেলিম সচেতনভাবে বর্জন করেছেন, কারণ তিনি জানেন বাঙালির নাট্যচেতনার উৎস যেসব শিল্পকর্মে সেখানে ওই গড়ন নেই।’
সাম্প্রতিককালের শিল্প-মডেলে অনেকের মধ্যেই সেলিম ঔপনিবেশ বিরোধী মানসিকতার প্রকাশ দেখলেও তাদের মধ্যে তাত্ত্বিকভূমির সঙ্কট উপলব্ধি করেছেন। হাজার বছরের বাঙালির আত্মপ্রকাশ ভঙ্গির ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ ও অনুন্ধানজাত উপলব্ধিবোধের আদলে সেলিম তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিলেন। যে তত্ত্বের ভিত্তিই হলো উপনিবেশ বিরোধী ও মননশীলতায় দেশজ শিল্পাদর্শ অভিমুখী। তাঁর ভাষায় : ‘সাম্প্রতিককালে বাংলা সাহিত্যের একটা ধারায় ঔপনিবেশকালের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে তাত্ত্বিক লড়াইটা চলছে সেটা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠতো যদি না আমাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা অভ্রান্ত আসন করে না নিতো।’
তাঁর তাত্ত্বিক ভিত্তিটি দৃঢ়তর ছিল বলেই কেবল শিল্পভাবনার অনুষঙ্গেই নয় বরং তত্ত্বের আলোয় তাঁর জ্ঞানসাধনার সকল মার্গ- তাঁর জীবনবোধ, দর্শন, রাজনৈতিক সচেতনতা। সর্বোপরি বাংলার সমৃদ্ধ মানবকে পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে সেই তাত্ত্বিকবোধ মাথা তুলে দাঁড়ায় সেলিমের শিল্পচেতনার ভিত্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচতির অন্তর্নিহিত এইপর্বে এমন এক সত্যের দিকে ধাবমান হওয়া সম্ভব যেখানে দাঁড়িয়ে অন্তত আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম যে, তিনি তাঁর স্বদেশ ও স্বদেশের মানবকৃত্যের মহাকাব্যিক প্রকাশ ও বিবেচনাকে নিজেদের শিল্পরুচি শিল্পতাত্ত্বিক পটভূমিতে স্থাপনপূর্বক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উৎসাহী। যার শেকড় সহস্রবর্ষের বাংলা নন্দনভুবনের মার্গীয় সমৃদ্ধির ধারায় বাহিত। এই মার্গীয় পথের শিল্পসাধনায় সেলিম হয়ে ওঠেন যথার্থ অর্থেই স্বভূমির এক বরপুত্র, নাট্যকার ও শিল্পতাত্ত্বিক।
নাট্যকার ও শিল্পতাত্ত্বিক হিসেবে সেলিম তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার আলোয় উপলব্ধি করেছেন পাশ্চাত্য শিল্পবুদ্ধির আবেশায়নে বিভ্রান্তির এক চরম উৎকেন্দ্রিক পথে ধাবমান যাত্রী হয়ে ওঠা আমাদের সৃজনকলার সর্বগ্রাসী বিনাশ। সেই পতনের তামস-অন্ধকার থেকে প্রাচ্যের মৌলিক শিল্পদর্শনের নৈয়ায়িক শৃঙ্খলায়- আরো কেন্দ্রিভূত করে বললে বাংলার শিল্পসাহিত্য ও কৃষ্টিকলাকে সহস্রবর্ষের ঐতিহ্যিক শিল্পবুদ্ধি ও বিশ্লেষণের ধারায় সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি।
সেলিমের গভীর বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্য-পণ্যসভ্যতার সর্বগ্রাসী সংবর্ত থেকে বাঙালির শিল্প ও শিল্পতত্ত্ব প্রাচ্যের বিবেচিত পথেই বিশ্বসাহিত্যের স্রোতধারাকে উজ্জ্বল করে তুলবে। তাই দৃঢ়তার সাথে তিনি তাঁর শিল্পচেতনায় অবস্থান করেন স্বদেশের বিস্তৃত পটভূমিকায়। আবার স্বভূমির ওপর দাঁড়িয়েই তিনি শিল্পচৈতন্যের বাহু প্রসারিত করেন শিল্পভাবনার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে।
সেলিম আল দীন (১৯৪৮-২০০৮) আমাদের মাঝে শিল্প ও জীবনানুষঙ্গে বেঁচে ছিলেন প্রায় ছয় দশক। এর মধ্যে নাট্যকার হিসেবে তিন যুগের অধিক নয় কোনো মতে। শিল্পের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমরা দেখি সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের স্থিতধি ও যথার্থ একটি সমুন্নতির লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক বিভ্রান্ত সময় পার হতে হয়। সেলিম আল দীন সেই বিভ্রান্ত সময় পার করেছিলেন নাট্যরচনা কৌশলের ছাঁচ বদলের নিরীক্ষার মাধ্যমে। ফলে, কথিত বিভ্রান্তির কুহক তাকে প্রতারিত করতে পারেনি। তার আগেই তিনি স্থিতধি সাফল্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। কিত্তনখোলা সময়পর্ব থেকে তিনি যে শিল্পভুবনের সিংহদ্ধারের সন্ধান লাভে সক্ষম হয়েছিলেন সেই পথই তাঁকে কাঙ্খিত স্বর্ণমন্দিরে পৌঁছে দিয়েছিল। আর সেই স্বর্ণ মন্দিরের- সেই যক্ষপুরীর তাল তাল স্বর্ণদানা সংগ্রহের মাধ্যমে সেলিম আল দীন তাঁর নাটকগুলোকে করে তুলেছিলেন অপূর্ব বিভাময়ী ও নন্দন সম্পদে ঐশ্বর্যশালিনীরূপে।
আমরা তার সৃষ্টিজগতের বিস্ময়ের সঙ্গে বাঙালির চিরকালীন শিল্পচিন্তার সম্মিলন লক্ষ্য করি। আর এই সম্মিলন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন একধরনের প্রত্নপরিব্রাজক। মনে রাখা ভালো, সম্প্রদায় বা কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী তাঁর নাট্যশরীরের আধার ও আধেয় হলেও জীবনবোধের গভীরতায় নাট্যচরিত্ররা আধুনিক জীবনের অভিজ্ঞতায়ও কম জর্জরিত নয়।
সেলিম আল দীনের নাটকে বিধৃত যে কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষের অভিব্যক্তি থেকেও নিজদেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, মানবিকবোধ প্রভৃতি সর্ম্পকে আমাদের নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত আধুনিকতার অভিজ্ঞতাকেও জর্জরিত করে। নিমজ্জন, স্বর্ণবোয়াল, ঊষাউৎসব, ধাবমান, পুত্র, স্বপ্ন রমনীগণ প্রভৃতি নাটকে বর্ণিত অভিঘাতের ব্যঞ্জনা তীব্রতার সঙ্গে অনুভূত হয়। ফলে আমরা সভ্যতার আয়নার বিপরীতে নিজেদের দাঁড় করিয়ে মানুষ হিসেবে পুর্নমূল্যায়নটুকু এক নজরে করে নিতে পারি। পাশাপাশি, মানব ভ্রূণের অকাল অপচয়, মানবমৃত্যু, বিশ্বভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির বিপরীতে মানুষ যে কি পরিমাণ অসহায় একাধিক নাটকের বিচিত্র অনুষঙ্গে তিনি সে অভিব্যক্তির প্রকাশেও সর্বদা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। বাঙালির আত্ম-অন্বেষণে তাই সেলিম আল দীন অবশ্য পাঠ্য, অবশ্যই বিবেচ্য।
লেখক : অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম