২৭ নং উপপাদ্য, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং কর্মজীবন
আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার জন্য আতংক ছিল পীথাগোরাসের ২৭ নং উপপাদ্য (উপপাদ্য নম্বরটি স্মৃতি থেকে লেখা। যতদূর মনে পড়ছে ২৭ নংই ছিল) । উপপাদ্যটি ২০ বার দেখে দেখে লিখে আমি মুখস্থ করেছিলাম। নবম শ্রেণির উপপাদ্যটি আমার জীবনে আতংক ছাড়া আর কিছু যুক্ত করতে পেরেছে এমন প্রমাণ পায়নি।
একবারে সাধারণ সরকারি প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুলে পড়ালেখা আমার। আমাদের সব শিক্ষার্থীর ‘জার্নি বাই বোট’ রচনাটা একই ছিল। এমনকি ‘ফেবারিট হবি’ বা ‘ফেবারিট গেম’ বা ‘লিভ অ্যাপ্লিকেশনের’ ভাষা, লেখা হুবহু হত। কারণ সব ক্ষেত্রেই আমাদের ভরসা ছিল ‘মুখস্থ শক্তি’।
পরীক্ষায় পাশ করতে বা ভালো রেজাল্ট করতে রচনা, প্যারাগ্রাফ, অ্যাপ্লিকেশন সবই মুখস্থ করতাম আমরা। ফলাফল আজ এত বছর পরে এসেও ঝরঝরে ইংরেজি লিখতে বেগ পেতে হয়। আর খুব প্রয়োজনীয় বিদেশি এই ভাষাটি শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে, বলতে প্রয়োজনীয় ইংরেজি গ্রামার শেখাটা ছিল রীতিমত যুদ্ধ।
টেনস বা পার্টস অফ স্পিচ এর সব কিছুই মুখস্থ করাই ছিল ভরসা। কেন টেনস শিখব, পার্টস অফ স্পিচ বাক্য গঠনে কি কাজে লাগবে, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার এর পরে কেন এস বা ই এস বসবে সেইসব কারণ সম্পর্কে কোনদিন বলেন নি কোন শিক্ষক।
আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এবং জানাশোনা বলে পরিস্থিতি এখনও এমন। এখনও লাখো শিক্ষার্থী মুখস্থ-র উপর ভরসা করেই ইংরেজি, বিজ্ঞান, অংকে পরীক্ষায় পাশ করছে। কি শিখছি কেন শিখছি সেই মন্ত্র থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ হাসিলের যুদ্ধ খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
আর এ কারণেই শিক্ষা জীবনের ১৫ বছর ইংরেজি, বাংলা শেখার পরও অনেকেই চাকরির ইন্টারভিউতে শুদ্ধ করে দুই লাইন ইংরেজি বা বাংলা লেখা বা নিজের জীবন বৃত্তান্ত যথাযথ রূপে উপস্থাপনের যোগ্যতাও অর্জন করতে বেগ পান।
কেবল বাংলা-ইংরেজি নয় ইতিহাস এবং বিজ্ঞানও শিক্ষার্থীদের কাছে আতংক হয়ে দাঁড়ায়। ইশা খাঁ এর যুদ্ধ সাল মনে রেখে পরীক্ষায় নম্বর জোটানোর দুশ্চিন্তায় এই বীরের কাহিনী হয়ে উঠে রসকসহীন।
অথবা কে কোন সেক্টরে যুদ্ধ করে কোন স্থানে মারা গেছেন সেইসব সারি সারি তথ্য মুখস্থ করতে গিয়ে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাটা আর একটা যুদ্ধে পরিণত হয়। বিজ্ঞানের মজার এক্সপেরিমেন্ট অথবা ভূগোলের কত অজানারে বিষয়গুলো পরীক্ষায় নম্বর ভীতির জন্য মুখস্থ সর্বস্বই থাকে।
অথচ একটি বার পরীক্ষা পাশের দুশচিন্তা সরিয়ে রেখে প্রথম শ্রেণিতে ভর্ হওয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব শিক্ষার্থীকে জানার জন্য শেখার জন্য পড়তে উদ্বুদ্ধ করলে এই চিত্রটা আমূল-ই বদলে যেতে পারে। সেখানে একজন শিক্ষার্থীকে ‘ভার্ব’ নামের জারগনটি মুখস্থ করার বদলে ‘ডুয়িং ওর্য়াডস’ শেখানোর চেষ্টা শুরু হতে পারে।
অথবা বাক্য গঠনে ভার্ব কেন অপরিহার্য এবং কিভাবে কাজ করে বা ভার্ব শিখলে কি লাভ সেগুলো থেকে শেখানো যেতে পারে। তাহলে সবার ‘জার্নি বাই বোট’ একই না হয়ে আলাদা হয়ে উঠবে আর ভুল লিখতে লিখতে একসময় ঝরঝরে শুদ্ধ ইংরেজি বা বাংলা লেখার সক্ষমতা তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য সক্ষম করে তোলা। লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবন যখন শুরু হয় তখন সেই সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিটি পদে পদে। বহু রাতের ঘুম হারাম করে আতংকগ্রস্থ শৈশব, কৈশর, তারুণ্য পেরিয়ে অর্জন করা সার্টিফিকেটগুলো তখন কেবল বন্দি থাকে দেরাজে। কর্ম জীবন শুরুতে খানিকটা ভূমিকা রাখলেও সক্ষমতার পাল্লায় সার্টিফেকট কতটা নগণ্য হয়ে উঠে তা কর্মজীবী মাত্রই জানেন।
২৭ নম্বর উপপাদ্য দিয়ে শুরু করেছিলাম। বরাবর মানবিকের শিক্ষার্থী আমার জন্য গণিতের মৌলিক জ্ঞানগুলোই এখন কর্মজীবনের বা প্রাত্যহিক জীবনের সম্বল। উপপাদ্যের জটিলতার ভেতরে আমাকে না আটকালে মৌলিক গণিত আমি হয়ত আরো একটু ভালো করে শিখে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারতাম। আবার যারা বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া শেষ করেছেন তাদেরকে ইতিহাসের সালের জালে না আটকালে তাদের পীথাগোরাস পড়াটা আরো আনন্দময় হয়ে উঠতে পারত।
ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই আছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই মেধার জোরে, ভালো পরিবার পেয়ে বা ভালো শিক্ষক পেয়ে অনেকেই হয়ত আনন্দ নিয়ে শিখছেন আর সক্ষমতা অর্জন করছেন। তবে সেটা সার্বজনীন নয়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য জানার জগতের পরিধি বিস্তৃত করে সক্ষমতা অর্জন। তাই পরীক্ষা, জিপিএ জুজুর ভয়ে শিক্ষাজীবন আতংকিত আর মলিন না করে জানা আর শেখা মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে তোলা বড় জরুরি। তাহলে বদলে যেতে পারে ব্যক্তি জীবনের, সমাজের, দেশের এমনকি পৃথিবীর অনেক পরিসংখ্যান।
লেখক : জনসংযোগ পেশাজীবি।
এইচআর/জেআইএম