রিয়েল হিরো অ্যান্ড সিপিবি কোং লি.
না জিতেও ইতিহাসে জয়ের আসন পেয়েছেন অনেকে। ইতিহাসে তার উদাহরণ ভুরি ভুরি। লোকাল মার্কেটে হালনাগাদে সেখানে এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে নামা হিরো আলমের নাম তালিকাভুক্ত করা কি বেশি দোষের হবে? অন্তত বিএনপি বা যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে তুলনা করলেও তিনি একটু-আধটু ভিন্ন মর্যাদা কি পেতে পারেন না? কারচুপি হাতেনাতে ধরিয়ে, দুর্বৃত্তদের দৌড়ানি দিয়ে শেষে মার খেয়ে মাঠ ছেড়েছেন তিনি। নির্বাচনের মাঠে এমন মুরদ কি আর একজনও দেখাতে পেরেছেন?
ভোটের রাজনীতিতে একজন জনপ্রতিনিধি হতে আগ্রহীর করণীয় যা আছে তার একটিও বাদ দেননি হিরো আলম। সবই করেছেন। চরম বৈরি পরিস্থিতি মোকাবেলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ, এমনকি প্রতিরোধের চেষ্টাও করেছেন। সেই চেষ্টাটাও তিনি করেছেন একদম একা। তার কোনো দল নেই, বিশাল কর্মীবাহিনীও নেই। ভোটের মাঠে তার নাজেহালের ভিডিও ফুটেজগুলো যারা দেখেননি তারা বিশেষ কিছু একটা মিস করেছেন।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ভোট কেন্দ্রে অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি শুরুর দিকে একাই ধাওয়া দিয়েছেন ভোট কাটাকুটির জালিয়াতদের। শুরুতে এদের কয়েকজন ছিঁচকে চোরের মতো পালিয়েছে। পরে সংগঠিত হয়ে তাকে লাঞ্ছিত করেছে। লাঞ্ছিত হওয়ার সময়ও হিরো আলম কাতচিৎ হননি। লিকলিকে শরীরের প্রতিবাদ করছিলেন প্রবলভাবে। এটাই তো একজন হিরোর স্পিরিট। নেতৃত্বের প্রকাশ।
বাস্তবতা হচ্ছে, তার পাশে কেউ এগিয়ে আসেননি। যদিও ওজনে ৫টন মার্কা পাকনা কথা আমরা বলেই যাচ্ছি। বড় বড় নেতা, দল-জোটের ভুলত্রুটি ধরার ওস্তাদের অভাব নেই। কোনো জালিয়াত, লুটেরা, কালপিটকে একা পেলেও রুখে দেয়া দূরে থাক- দু’টা কথা শোনানোর মরদের খবরও আমাদের কাছে নেই।
এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের হিরো আলমদের জোকার ভাবতেই স্বস্তি আমাদের। আলমকে হিরো আলম নামে মেনে নিতেও অনেকের সমস্যা। তৃপ্তি হয় উপহাস করতে। তার বাঙ্গালপনা আর তথাকথিত আনস্মার্টনেস নিয়ে মশকরায় তৃপ্তি। আলম নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি অভিনয়, গান, নাচ জানেন না- তার ভালোলাগে তাই তিনি পারফর্ম করেন- এটাই হিরোইজম।
আমরা মানতে রাজি নই, এইট পাস আলম যে ভুল বানানে আর ভুল ইংরেজি হরফে বাংলা লেখে সেটাই তার বাংলা। ভাষার কাজ মনের ভাব প্রকাশ করা- সে তার আজন্ম কথা বলার ভাষাতেই মনের ভাব প্রকাশ করে, বাংলা লেখে। তাই তার মৌখিক উচ্চারণের 'বালোবাসা'কে 'বালোবাসা'ই লিখে। ওই ল্যাচকা-ল্যাটকা ভাষায়ই আলোচিত হিরো আলম বলেছেন, ‘সচিবরা হচ্ছেন রাষ্ট্রের চাকর। জনগণের টাকায় তাদের বেতন হয়। বিষয়টি তাদের মনে রাখা দরকার। জনগণের সঙ্গে আদব নিয়ে কথা বলা দরকার।’
নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে নিয়ে কথাগুলো বলেন তিনি। কেন এই বেয়াদবি? তাকে নিয়ে ইসি সচিবের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায়ই হিরো আলম এমন বাংলা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, একজন সচিব এমপি প্রার্থীর সঙ্গে তুই-তোমারি করে কথা বলতে পারেন না। তিনি আমারে ইনসাল্ট (অপমান) করে কথা বলেছেন। আমি সচিবের কথার নিন্দা জানাই এবং তার পদত্যাগ দাবি করছি। হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে ব্যালট পেপার ছাপানো নিয়ে বিড়ম্বনার কথা বলতে গিয়ে ইসি সচিব ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘হিরো আলম পর্যন্ত ইসিকে হাইকোর্ট দেখায়। সেও বলে যে, নির্বাচন কমিশনকে হাইকোর্ট দেখিয়ে ছাড়ছি; বোঝেন অবস্থা!’
সচিবের এমন তাচ্ছিল্যেরই জবাব দিয়েছেন হিরো আলম। এর কাছাকাছি অপমান-ইনসাল্ট হয়েছেন বিরোধীমতের বাঘা-বাঘা নেতা ও প্রার্থী। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেননি বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের স্বতন্ত্র- অখ্যাত এই প্রার্থীর মতো। ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের পদত্যাগও দাবি করেন হিরো আলম।
বগুড়া-৪ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আলোচিত অভিনেতা হিরো আলম। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়ন বাতিল করেন। ইসিতে আপিল করেও প্রার্থিতা ফিরে পাননি হিরো আলম। পরে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট তার মনোনয়নপত্র গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরে হিরো আলম বলেন, ইসিকে হাইকোর্ট দেখিয়ে ছাড়লাম।
নির্বাচন বা ফলাফল বাতিলের দাবির সপক্ষে যুক্তি-শব্দ, ভাষার ক্ষেত্রেও কেউ হিরো আলমের মতো বাঙাল হতে পারেননি। এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবাদের মধ্যে তুলনামূলক সাহসী ও ব্যঞ্জনাময়তা দেখা গেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবির মধ্যে। তারা এবারের নির্বাচনকে ‘ভুয়া ভোটের ভুয়া নির্বাচন’ বলে অভিযোগ করেছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-সংক্রান্ত বিবৃতিতে । এতে বলা হয়, ‘ভুয়া বিজয় নিশ্চিত করার জন্য নানা ধরনের প্রহসন ও কারচুপির বলয় আগেই তৈরি করেছিল শাসক দল। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যূনতম ভিত্তিকে বলি দেয়ার ব্যবস্থা তারা আগেই করে রেখেছিল।’
কেন্দ্রে নামমাত্র ভোটারের উপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের জোর করে বের করে দিয়ে এবং আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে বিতাড়িত করে, প্রকাশ্যে সিল মেরে ‘ভুয়া ভোট’ বাক্সে ঢোকানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সিপিবি। নানা সমালোচনার পরও সিপিবিসহ কয়েকটি বাম দল এবার কমজুরিতে হলেও নিজেদের অস্তিত্ব দেখানোর সাহস করেছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিশেষ করে সিপিবি-কে সাথে পেতে আওয়ামী লীগের আগ্রহ লুকানো বিষয় ছিল না। নানা ব্যক্তি এবং সংস্থার মাধ্যমে সিপিবি-কে নির্বাচনী জোটে নিতে আওয়ামী লীগ চেষ্টার কোনো কার্পণ্য করেনি। রাজি হলে কয়েকটি এমপি পদ নিশ্চয়ই পেত সিপিবি। এমন ফাটাফাটি অফারে হয়তো পরবর্তীতে মন্ত্রিসভায়ও মাথা ঢুকাতে পারতো। দলটি কেন এই গোল্ডেন চান্স লুফে নেয়নি?- এ প্রশ্ন নেই রাজনীতির বাজারে। ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম দলটিও এখন পর্যন্ত ব্যাখ্যা করেনি এই হিরোইজমের কথা।
গত ১০ বছরে ১৪ দলভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল থেকে তবে কী শিক্ষা নিল তারা? উল্লিখিত দলগুলো কিছু এমপি-মন্ত্রী পেয়েছে, নিজেদের দলের কিছু আতিপাতিকে চাকরি, ব্যবসাপাতি দিতে পেরেছে। সামনে আরো পারবে। সিপিবি কি এতদিনে একটি স্বাধীন পার্টিতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে? নব্বই দশক পর্যন্ত মস্কো থেকে সিপিআই দিল্লীর ভায়া হয়ে অহির মতো সিদ্ধান্ত আসত তাদের কাছে। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরেও অনভ্যাসের কারণে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না সিপিবি। সেই অবস্থা কাটিয়ে দুর্বলতার মধ্যেও কি সাবল্যের হিরোইজমে পেয়েছে তাদেরকে?
এদেশে ভোট হয়। রাজা যায়, রাজা আসে। কত জনের ভাগ্য বদলায়। গাড়িতে পতাকা লাগে। ধন-তালুকে গায়ে লাগে চর্বির জেল্লা। কিন্তু হিরো পয়দা হয় না। মাঠে-ঘাটে কাজ করা আদমরা নিজেদের হিরো দূরে থাক, মানুষ ভাবতেও ভয়ে থাকে। তবু কাজ করে যায় নিবিষ্ট মনে। নিজেকে হিরো দাবি না করেই কাঁধে তুলে নেয় ১৬ কোটি মানুষের জোয়াল। নিজেদের সোনারং পুড়ে হয় কালো। জীবন হয় বিবর্ণ, ফ্যাকাশে। তাদের শ্রমে-ঘামেই সোনা ফলে। তৈরি হয় মাইলের পর মাইল রাস্তা, ব্রিজ। বস্ত্র উৎপাদন হয়। কলকারখানা চলে। রেমিটেন্স আসে। রক্ত সঞ্চালন হয় অর্থনীতিতে। বাড়ে আমাদের মাথাপিছু আয়। সঙ্গে আয়ুও।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর