‘বড়লোকের স্বামী’
‘বড়লোকের বউ’ বলতে এতদিন যা বোঝাতো, এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু অনেক প্রার্থীর হলফনামায় দেয়া সম্পদের বিবরণী দেখে মনে হচ্ছে, বিষয়টা উল্টো।
সমাজে ধনবান হিসেবে পরিচিত অনেক রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতি নির্বাচনী হফলনামায় যে ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে তাদের স্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ তাদের চেয়ে অনেক বেশি। কারো কারো ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, বরং হাস্যকরও বটে।
সমাজে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত এই ব্যক্তিদের সম্পদের পরিমাণ দেখে অনেক মধ্যবিত্তও নিজেকে বরং সম্পদশালী ভাবতে পারেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, সেই ব্যক্তিদের স্ত্রীদের সম্পদ কয়েকশো গুণ বেশি। অর্থাৎ এখানে বড়লোকের বউ বিষয়টি উল্টে গিয়ে হয়েছে ‘বড়লোকের স্বামী’। শব্দটি জেন্ডার সংবেদনশীল হলেও আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই সংবেদনশীলতাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
দেশবাসী এতদিন যাদের কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক বলে জানতো, বিস্ময়করভাবে দেখা যাচ্ছে তারা আসলে কেউই ধনী নন! অনেকের আর্থিক অবস্থা এমনই যে, তাদের সম্পদের বিবরণ দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ওইসব কথিত গরিবের প্রতি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। আবার তারা নির্বাচনী হলফনামায় দেয়া সম্পদের বিবরণীতে অধিকাংশ সম্পদের মালিক স্ত্রীদের দেখানোর কারণে দেশবাসী জানতে পারছে, আমাদের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ তাহাদের স্ত্রীদের কী ভীষণ ভালোবাসেন!
দেশের একজন শীর্ষ শিল্পপতি তার সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন, তার নিজস্ব কোনো বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নেই, নেই কোনো আসবাবপত্র ও বৈদেশিক মুদ্রা। এমনকি তিনি ঋণখেলাপী তো দূরের কথা, ব্যাংক থেকে কোনো ঋণই গ্রহণ করেননি। অথচ ঋণখেলাপী হিসেবেই দেশবাসী তাকে চেনে।
চীনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হুরুন গ্লোবালের তথ্য অনুযায়ী, ওই ব্যবসায়ীর সম্পদের পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। তবে এটা ঠিক, যে ব্যবসায়ীর কথা বলা হচ্ছে, তার দেনার পরিমাণ এত বেশি যে, ওই দেনা থেকে তার সম্পদ বিয়োগ করলে হয়তো কিছুই থাকে না।
তিনি বর্তমানে যে ফ্ল্যাটে থাকেন, সেটি তার নিজের নয়; বরং ভাড়া বাড়ি। আর সে বাড়ির আসবাবপত্রও তার কেনা নয়। বরং ফার্নিশড ফ্ল্যাট। ফলে হলফনামায় তিনি যে গরিবি চিত্র দিয়েছেন, তা এক অর্থে সঠিক। আবার তিনি ঋণ নেননি বলে যে দাবি করেছেন, তাও এক অর্থে সঠিক এ কারণে যে, তিনি নিজের নামে হয়তো কোনো ঋণ নেননি। নিয়েছেন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নামে। ফলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে ঋণখেলাপী বলার সুযোগ নেই।
ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতা তার হলফনামায় লিখেছেন তার হাতে আছে মাত্র ৫৫ হাজার টাকা। আর আয়ের উৎস দেখিয়েছেন লেখালেখি। যদিও তিনি কোথায় লেখেন এবং কী লেখেন, তা পাঠকরাই ভালো বলতে পারবেন। তার দাবি, রাজধানীতে তার কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই। থাকেন স্ত্রীর বাড়িতে। তার মতো একজন প্রভাবশালী নেতার হাতে মাত্র ৫৫ হাজার টাকা আছে এবং নিজের কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই—এই তথ্য জেনে অনেক গরিব মানুষও নিজেকে এখন ধনী ভাবতে পারেন।
বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, তার ব্যাংক হিসাবে রয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। তবে তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে ২১ লাখ ৭২ হাজার ৮৭০ টাকা। সাবেক এই মন্ত্রী লিখেছেন, তার নিজের কোনো গাড়ি নেই। বরং স্ত্রীর দেয়া গাড়ি ব্যবহার করেন। দেখা যাচ্ছে, সবাই স্ত্রীদের ফ্ল্যাটে থাকেন এবং স্ত্রীদের দেয়া গাড়িতে চড়েন। মানে তাদের চেয়ে তাদের স্ত্রীরাই বেশি সম্পদশালী।
‘গরিব’ স্বামীদের বড়লোক স্ত্রীদের কেউ কেউ অবশ্য প্রার্থীও হয়েছেন। কিন্তু তারাও হলফনামায় যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা নিয়েও রসালো আলোচনা ফেসবুকে। যেমন ইয়াবা ব্যবসার সাথে যুক্ত ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগের মুখে থাকা কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির বদলে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন তার স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরী।
তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ১৫ ভরি স্বর্ণের মালিক, যার মূল্য ৪৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম মাত্র ৩ হাজার টাকা। তাছাড়া তার বাসায় যেসব আসবাবপত্রের (ডাইনিং টেবিল, সোফা, খাট, আলমিরা, ওয়ারড্রব, ড্রেসিং টেবিল, শোকেস, আলনা) উল্লেখ করেছেন, তার মূল্য বলেছেন ৩০ হাজার টাকা। সংগীতশিল্পী মমতাজ অবশ্য তার হলফনামায় স্বর্ণের দাম কিছুটা বাড়িয়েছেন। চার লাখ ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের তার কাছে ৩৫ ভরি স্বর্ণ আছে বলে উল্লেখ করেছেন। তাতে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম পড়ে ১২ হাজার টাকার কিছু বেশি।
হতে পারে মিসেস বদি ও মমতাজ সত্তুর আশির দশকের কথা বলছেন। কেননা তখন স্বর্ণের দাম বেশ কম ছিল। কিন্তু ক্যারেট ভেদে এখন স্বর্ণের দাম ৪০ থেকে ৫০ হজার টাকা। তাছাড়া আশির দশকে হয়তো একটি ডাইনিং টেবিল,সোফা, খাট, আলমিরা, ওয়ারড্রব ও ড্রেসিং টেবিল ৩০ হাজার টাকায় পাওয়া যেতো। কিন্তু সময় গড়িয়ে এখন যে ২০১৮ সাল, সেটি বোধ হয় তারা খেয়াল করেননি। করেননি বলেই বিষয়টা নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনী হলফনামা এখন বিনোদনেরও উৎস বটে!
হলফ করে সঠিক তথ্য দিতে হয় বলে এর নাম ‘হলফানামা’। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী মনোনয়পত্রের সাথে ৮টি তথ্য দিতে হয় প্রার্থীকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেকেই হলফ করে সঠিক তথ্য গোপন করেন। কেউ কেউ এমন মারপ্যাঁচ দিয়ে লেখেন যে, সেখানে চট করে ভুল ধরাও কঠিন। ধরা যাক একজন মন্ত্রী। তিনি সরকারি বাড়ি-গাড়ি পান, ভাতা পান। এর বাইরে নানা প্রকল্পের পার্সেন্টিজ তো আছেই।
খুব সৎ মন্ত্রীর বেলায় পার্সেন্টিজ না হয় বাদ দেয়া গেলো। কিন্তু সেই সংখ্যা কত? তিনি বলছেন যে, সরকার তাকে যে ভাতা দেয়, তার সবই খরচ হয়ে যায়। ফলে মাস শেষে হাত শূন্য। টানাটানির সংসার। এই তথ্য দিলে সেটি মিথ্যা প্রমাণ করা কঠিন, যতক্ষণ না দেশে-বিদেশে তার সম্পদের নিরপেক্ষ অনুসন্ধান হবে। আবার কোটি কোটি টাকার সম্পদ তিনি গড়ে তুললেও তার মালিকানা দিয়ে দেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে। যে কারণে দেখা যায়, যে প্রার্থী হলফনামায় নিজের সম্পদে দেখিয়েছেন এক লাখ টাকা; সেখানে তার স্ত্রীর সম্পদ হয়তো পাঁচশো কোটি টাকা। তো স্ত্রী এই সম্পদ কোথায় পেলেন? উৎস কী—এসব প্রশ্নের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অনুসন্ধান কি দুদক বা নির্বাচন কমিশন করবে? যদি না করে তাহলে তিনি যে সম্পদের বিবরণীতে নিজেকে ফকির-মিসকিন উল্লেখ করেছেন, তাই তো সঠিক প্রমাণিত হবে।
প্রশ্ন হলো, তারা কি এই হলফনামা এবং দুদকের তদন্ত এড়াতেই অবৈধভাবে অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পদগুলো স্ত্রীদের নামে রাখেন? কিন্তু স্ত্রীদের নামে হলেও এটি তদন্তের ঊর্ধে থাকবার কথা নয়। বরং স্ত্রী যদি বড় ব্যবসায়ী না হন এবং তার যদি দৃশ্যমান কোনো বড় আয়ের খাত না থাকে, তাহলে সেই সম্পদের উৎস অনুসন্ধান হতেই পারে। কিন্তু সবার সম্পদ বা ফাইল বোধ হয় অনুসন্ধানযোগ্য নহে।...
তবে এই হলফনামার ডামাডোলে আরেকটা বিষয় আলোচনার বাইরে থেকে যায়, সেটি হলো নির্বাচনী ব্যয়। আইনত জাতীয় নির্বাচনে একজন প্রার্থীর ব্যয়ের সীমা ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেও জানে, এই টাকায় নির্বাচন হয় না। বরং কোনো কোনো প্রার্থী এমপি হওয়ার জন্য মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত ২৫ কোটি টাকাও খরচ করেন।
নির্বাচনের পরে সব প্রার্থীকে তাদের নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব জমা দিতে হয়। কিন্তু সবাই দেন না। আবার যারা দেন তারাও সঠিক হিসাব দেন না, তা নিয়ে সন্দেহ না করাই ভালো। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব জমা না দেয়ায় ১১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, যাদের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, এহছানুল হক মিলন, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীও ছিলেন (সূত্র: জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর, ৬ অক্টোবর ২০০৯)।
আবার ব্যয়ের হিসাব জমা দিলেও এসব হিসাবের গড়মিল খুঁজে দেখে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে কি না সন্দেহ। এমনকি নির্বাচন কমিশন দৈবচয়ন পদ্ধতিতেও কিছু এমপির নির্বাচনী খরচ অনুসন্ধান করে তার প্রকৃত চিত্রটি প্রকাশ করেনি বা মামলা করেনি। ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার জন্য যে হলফনামা এবং ভোটের পরে ব্যয়ের হিসাব বিবরণী জমার বিধান করা হয়েছে, তা এখনও কেতাবি বিষয় হয়েই আছে। এর দ্বারা মানুষের কিছু বিনোদন এবং গণমাধ্যমের কিছু খবরের উপাদান তৈরি হওয়া ছাড়া রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য তা আসলে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, সে প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম