সংলাপ-সমঝোতা-নির্বাচন : জনগণ কী চায়?
সমঝোতার শেষ চেষ্টা আগামীকাল- এরকম একটি শিরোনাম দেখা গেল একটি জাতীয় দৈনিকে আজ। পুরো সংবাদটি পাঠে বোঝা গেল যে, আগামীকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় বৈঠককে পত্রিকাটি দু’পক্ষের মাঝে সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবেই দেখছে।
এর আগের বৈঠকে যে কিছুই হয়নি তা কোনো পক্ষই অবশ্য বলছে না। বরং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, তাদের কাছে সংলাপ ফলপ্রসূ মনে হয়েছে। অপরদিকে ড. কামাল হোসেনও বলেছেন যে, তিনি আশাবাদী। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে গণভবনে অনুষ্ঠিত এই সংলাপটি ছিল ‘অসন্তোষের’ এবং চরম ‘ছোটলোকিতার’। তার মানে হচ্ছে যে, ঐক্যফ্রন্টের চিন্তা-চেন্তার একটি মোটা দাগের পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। শুরু থেকেই এই পার্থক্য লক্ষ্যমান। সংলাপকে কেন্দ্র সেটা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী পক্ষ বিএনপি। এই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই ঐক্যফ্রন্টে ড. কামাল হোসেন এতোদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তিনি অন্ততঃ এটি নিশ্চিত করতে পেরেছেন যে, সরকারকে আলোচনায় বসার চিঠি দিয়ে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে সংলাপে বসাতে রাজি করাতে সমর্থ হয়েছেন।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিএনপি নেত্রীর কাছে সংলাপের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল অত্যন্ত রূঢ় ভাষায়। এরপর থেকে বাংলাদেশে আর কোনো সংলাপ-প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের চিঠির জবাবে জাতিকে একটি চমক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই চমকিত সংলাপ হয়েছে। এবং তারপরও আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ঐক্যফ্রন্টে যেনো নতুন সুর বাজছে। যে সুরে আসলে অনেকেই সুর মেলাতে পারছেন না।
সংলাপের পর পরই ড. কামাল হোসেনকে কৌশলে বক্তব্য প্রদান থেকে একটু দূরে রাখা হয়েছে। ঐক্য ফ্রন্টের একাধিক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যায়নি এবং মুখপাত্র হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য রাখছেন মিডিয়ার সামনে। কাদের সিদ্দিকীকেও ড. কামাল হোসেন টেনে এনেছেন ঐক্যফ্রন্টে। তাতে শক্তি বেড়েছে কি বাড়েনি সে প্রশ্ন তোলা থাক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাদের সিদ্দিকীর আমন্ত্রণে ড. কামাল হোসেন ৩রা নভেম্বর অনুষ্ঠিত জেলহত্যা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এবং যথারীতি জাতীয় চার নেতা সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন।
এখন যদি ৭ই নভেম্বর বিএনপি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’র অনুষ্ঠান আয়োজন করে তাহলে ড. কামাল কি সেখানেও যাবেন কিনা সে প্রশ্নও জাগ্রত হয়ে ওঠে। দুই অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং একপক্ষ এখানে খুন হয়েছে আরেকপক্ষ সে খুনের সঙ্গে জড়িত বা মদদদাতা বা সুবিধাভোগী। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এরকম স্ব-বিরোধিতা ও আলোচিত প্রশ্নকে নিয়েই এগুচ্ছে বটে।
যে কথা বলছিলাম, ড. কামাল হোসেন এখন আর খুউব বেশি মুখ্য নন এই ফ্রন্টে। আগামী কালকের সংলাপের জন্য কয়েকজন নতুন ব্যক্তিত্বের নাম যোগ করা হয়েছে, যারা ‘এক্সপার্ট’ হিসেবে নতুন করে সংলাপে যোগ দেবেন। মজার ব্যাপার হলো, তারা নিজেদেরকে অ-রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। যদিও তারা কথায়, কাজে ও আচরণে সর্বোতভাবেই বিএনপি’র সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতাকে কখনও গোপন করেন না, তবুও তারা অ-রাজনৈতিক।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন একটি শব্দও যদি কেউ লেখায় বা বক্তব্যে উল্লেখ করে থাকেন তাহলে তাকে আপাদমস্তক ‘আওয়ামী লীগার’ ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয় বাকি জীবনের জন্য। বাংলাদেশে এও এক বিস্ময়কর আচরণ, যা যে কোনো মানুষকে বিস্ময়াহত করবে। ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে নিজে গণফোরাম নামক দল খুলেছেন। সেখানে খুব বেশি সুবিধে হয়নি। এখন তিনি বিএনপি এবং বিএনপি’র মিত্র শক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গড়েছেন।
বিএনপি’র রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি অজ্ঞাত নন, তিনি কেন কেউই অজ্ঞাত নয় এদেশে। তার রাজনীতি, জীবনাচরণ এবং বাংলাদেশ-ভাবনার সঙ্গে (অন্ততঃ মুখে তিনি যা বলে থাকেন সচরাচর) বিএনপি’র রাজনীতি যায় না। তবু তিনি তাদের নেতৃত্ব দিয়ে গণভবন পর্যন্ত সংলাপে নিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসাতে পেরেছেন, ড. কামাল হোসেনের রাজনীতির এই সার্থকতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাস হয়ে থাকবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে নতুন কিছু আসবে কি?
গত দুই দিনে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ ড. কামাল হোসেনকে ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের সংবাদ আমরা পেয়েছি গণমাধ্যম থেকেই। ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতার পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এক প্রকার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-এ দেশে থাকতে হলে তাদের কথা শুনতে হবে এরকমই একটি হুমকি। ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চাওয়া একজন নেতা অত্যন্ত নেতিবাচক ও অসহিষ্ণু আচরণ করছেন, যা জনগণের নজর এড়াচ্ছে না।
সারাক্ষণ এক ভয়ঙ্কর রাগ নিয়ে তিনি কথা বলেন, সেটা ঐক্যফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলন হোক কি যে কোনো টিভি আলোচনা হোক। বোঝাই যায় তার সকল রাগ এই সরকারের প্রতি, শেখ হাসিনার প্রতি। ক্ষমতায় এলে তিনি বা তার সঙ্গীরা এই রাগ গোপন করবেন বা নিমিষে মিটিয়ে ফেলবেন সেটা ভাববার নিশ্চিত কোনো কারণ নেই। তার মানে সেই যে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে মানুষের মনে সেটা থেকে মানুষ এখনও বেরিয়ে আসতে পারছে না, ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এরকম নেতিবাচক আচরণে।
ড. কামাল হোসেনও ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েই রেখেছেন যে, এমন শাস্তি তিনি আওয়ামী লীগকে দেবেন যে, কেউ কল্পনাতেও তা আনতে পারবে না। এমতাবস্থায়, আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো ভাবেই কি খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসা সম্ভবপর হবে? তাও আওয়ামী লীগ বসছে, মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে দিচ্ছে এই সংলাপ, এটাই হয়তো এর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। বাকিটুকু নিঃসন্দেহে কাল পরিষ্কার হবে।
ধরা যাক সংলাপ সফল হলো এবং দুই বিবদমান পক্ষ একটি মধ্যপন্থা খুঁজে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্রতী হলো এবং নির্বাচনে সকল পক্ষ অংশ নিয়ে একটি সরকার গঠিত হলো। সে সরকার নিঃসন্দেহে হবে বাংলাদেশের অন্যতম কাঙ্খিত সরকার, তাইতো? কিন্তু তাতে কি প্রতিবারের মতো এই নির্বাচনকে সামনে রেখে জোরপূর্বক আলোচনা-সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নির্ধারণ বন্ধ হবে? অর্থাৎ একটি স্থায়ী সাংবিধানিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া কি আমরা দেখতে পাবো?
নাকি প্রতিবারের মতো নতুন সরকারও নিজেদের অনুকূলে যায় এরকম একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই নিজেদের আটকে রাখবে? অপরদিকে, নতুন সরকার কি দেশের রাজনীতিতে যে কতোগুলো উদগ্র ক্ষত আছে, যে প্রশ্নগুলো আসলে আমাদের রাজনৈতিক ও জাতীয় শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে বলে সকলেই বিশ্বাস করেন যার অন্যতম হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক ও জাতীয় জীবনে সকল পক্ষের কাছে স্থায়ীত্ব দেওয়া- সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে পারবে?
ড. কামাল হোসেন যখন বিএনপি-নেতৃত্বের পাশে বসে বঙ্গবন্ধুকে বার বার জাতির পিতা বলে উল্লেখ করেন তখন কি সেটা বিএনপি-নেতৃত্ব সাময়িক ভাবে মেনে নিচ্ছেন নাকি বঙ্গবন্ধুকেই জাতির পিতা মেনে নিয়ে ভবিষ্যতে রাজনীতি করবেন সেটাও নির্বাচনের আগেই স্পষ্ট হওয়া উচিত নয় কি?
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, আগামী কালকের সংলাপ যদি ব্যর্থ হয় অর্থাৎ দু’পক্ষই তাদের দাবি-দাওয়ায় অনড় থাকেন তাহলে কী হবে? আজকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে পরবর্তী ‘কঠোর’ কর্মসূচি ঘোষণার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একদিকে সংলাপ আরেকদিকে কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়টি তার কাছে ঠিক বোধগম্য নয়।
দু’পক্ষ সংলাপে বসছে ঠিকই কিন্তু কোনো পক্ষই যে কাউকে খুউব একটা বিশ্বাস করতে পারছে না, সেটা কিন্তু স্পষ্টই জনগণ বুঝতে পারছে। তার মানে পরিস্থিতি যতোই আপাতঃ শান্ত থাকুক না কেন, উত্তপ্ত হতেও খুব বেশি সময় নেবে বলে মনে হয় না। তাহলে সেক্ষেত্রে কী হবে? বাংলাদেশ কি পারবে আরেকটি রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে এই সময়ে মেনে নিতে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, জনগণ এখন কোন ‘মোড’-এ আছে? যতোটুকু বোঝা যায়, জনগণ আসলে নির্বাচনী আমেজেই আছে। তারা একটি নির্বাচন চায় তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু সে নির্বাচনটি রাজনৈতিক পক্ষগুলো কী ভাবে জনগণকে উপহার দেবে সেটি এখনও অনিশ্চিতই। যে কোনো অনিশ্চয়তাই সংঘাতের পথকে উস্কে দেয়।
আমরা আশা করবো, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এই সংঘাত এড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করবে এবং আগামীকাল একটি সকল পক্ষের জন্য সুবিধাজনক পথ খুঁজে পাবে - এ পথ শুধু রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের জন্য নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির জন্যই অত্যন্ত জরুরি।
৬ই নভেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমএস